Monday, January 11, 2016

দু’জন

___জীবনানন্দ দাশ
‘আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন- কতদিন আমিও তোমাকে

খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু- একই আলো পৃথিবীর পারে

আমারা দু’জনে আছি; পৃথিবীর পুরোনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,

প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,

হয় নাকি?’- ব’লে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে;

আজ এই মাঠে সূর্য সহধর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে

প্রাণ তার ভ’রে গেছে। 



দু’জনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবী ও আকাশের পাশে

আবার প্রথম এলো- মনে হয়- যেন কিছু চেয়ে- কিছু একান্ত বিশ্বাসে।

লালচে হলদে পাতা অনুষঙ্গে জাম বট অশ্বত্থের শাখার ভিতরে

অন্ধকারে ন’ড়ে-চ’ড়ে ঘাসের উপর ঝ’রে পড়ে;

তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল। 



যেখানে আকাশে খুব নীরবতা, শান্তি খুব আছে,

হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হ’লে ক্রমে-ক্রমে যেখানে মানুষ

আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছেঃ

সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দু’জন; চারিদিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে

হেমন্ত আসিয়া গেছে;- চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি;

ঘুঘুর পালক যেন ঝ’রে গেছে- শালিকের নেই আর দেরি,

হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু ক’রে ঘুমাবে সে শিশিরের জলেঃ

ঝরিছে মরিছে সব এইখানে- বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে।



নারী তার সঙ্গীকেঃ ‘পৃথিবীর পুরোনো পথের রেখা হ’য়ে যায় ক্ষয়,

জানি আমি;- তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয়

কী নিয়ে থাকিবে বল;- একদিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা,

তারপর ঝ’রে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না

হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের- প্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত বাসনা

ফুরোত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয়ের থেকে-’

এই ব’লে ম্রিয়মাণ আঁচলের সর্বস্বতা দিয়ে মুখ ঢেকে

উদ্বেল কাশের বনে দাঁড়ায়ে রহিল হাঁটুভর।

হলুদ রঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছে, এলোমেলো অঘ্রাণের খড়

চারিদিকে শূন্য থেকে ভেসে এসে ছুঁয়ে ছেনে যেতেছে শরীর;

চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;-



প্রেমিকের মনে হ’লোঃ ‘এই নারী- অপরূপ- খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে;

যেখানে রব না আমি, রবে না মাধুরী এই, র’বে না হতাশা,

কুয়াশা র’বে না আর- জানিত বাসনা নিজে- বাসনার মতো ভালোবাসা


খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।’

বুনো হাঁস

_____জীবনানন্দ দাশ
পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে —
জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহ্বানে
বুনো হাঁস পাখা মেলে — শাঁই শাঁই শব্দ শুনি তার;
এক —দুই —তিন —চার —অজস্র —অপার —
রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া
এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে — ছুটিতেছে তারা।
তারপর পড়ে থাকে, নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,
হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ—দু-একটা কল্পনার হাঁস;
মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা স্যানালের মুখ;
উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক
কল্পনার হাঁস সব — পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেল পর
উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জোছনার ভিতর।