Friday, September 22, 2023

কষ্টের কস্তুরী

               ------তসলিমা নাসরিন


কিছু কিছু কষ্ট আছে
ক্ষতে কোন মলম লাগে না।
কারওর শুশ্রুষা নয়
গাঢ় মমতায় জেগে থাকা রাত নয়
হাওয়া পরিবর্তন, তা-ও নয়
সেরে যায়।
কিছু কষ্ট নিয়ত পোড়ায়
ক্ষুদ্র তুচ্ছ কিছু, ফুঁ মেরে উড়িয়ে
দেওয়ার মতো কিছু
কষ্টের ক্ষীণাঙ্গী শরীরেও
আগুনের আঁচ থাকে
সেইসব কষ্টগুলো
বর্শা বেঁধায় না....
দুই চক্ষু অন্ধ করে না, কেবল
কোথায় কীসব যেন
পোড়াতে পোড়াতে করে নিভৃত অঙ্গার।
কিছু কিছু কষ্ট আছে....
রাত পোহাবার আগে বাতাস মেলায়,
কিছু কষ্ট বাসা বাঁধে
ভালোবেসে থেকে যায় পুরোটা জীবন।

Friday, July 21, 2023

পরশ-পাথর

                                                    ------ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---সোনার তরী



খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।

   মাথায় বৃহৎ জটা                 ধূলায় কাদায় কটা,

        মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর।

   ওষ্ঠে অধরেতে চাপি            অন্তরের দ্বার ঝাঁপি

        রাত্রিদিন তীব্র জ্বালা জ্বেলে রাখে চোখে।

   দুটো নেত্র সদা যেন             নিশার খদ্যোত-হেন

        উড়ে উড়ে খোঁজে কারে নিজের আলোকে।

   নাহি যার চালচুলা            গায়ে মাখে ছাইধুলা

        কটিতে জড়ানো শুধু ধূসর কৌপীন,

   ডেকে কথা কয় তারে        কেহ নাই এ সংসারে

        পথের ভিখারি হতে আরো দীনহীন,

   তার এত অভিমান,            সোনারুপা তুচ্ছজ্ঞান,

        রাজসম্পদের লাগি নহে সে কাতর,

   দশা দেখে হাসি পায়          আর কিছু নাহি চায়

        একেবারে পেতে চায় পরশপাথর!

        সম্মুখে গরজে সিন্ধু অগাধ অপার।

   তরঙ্গে তরঙ্গ উঠি                 হেসে হল কুটিকুটি

        সৃষ্টিছাড়া পাগলের দেখিয়া ব্যাপার।

আকাশ রয়েছে চাহি,           নয়নে নিমেষ নাহি,

        হু হু করে সমীরণ ছুটেছে অবাধ।

সূর্য ওঠে প্রাতঃকালে           পূর্ব গগনের ভালে,

        সন্ধ্যাবেলা ধীরে ধীরে উঠে আসে চাঁদ।

জলরাশি অবিরল                 করিতেছে কলকল,

        অতল রহস্য যেন চাহে বলিবারে।

কাম্য ধন আছে কোথা        জানে যেন সব কথা,

        সে-ভাষা যে বোঝে সেই খুঁজে নিতে পারে।

কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নাহি,        মহা গাথা গান গাহি

        সমুদ্র আপনি শুনে আপনার স্বর।

কেহ যায়, কেহ আসে,        কেহ কাঁদে, কেহ হাসে,

        খ্যাপা তীরে খুঁজে ফিরে পরশ-পাথর।

        একদিন, বহুপূর্বে, আছে ইতিহাস--

নিকষে সোনার রেখা            সবে যেন দিল দেখা--

        আকাশে প্রথম সৃষ্টি পাইল প্রকাশ।

মিলি যত সুরাসুর                  কৌতূহলে ভরপুর

        এসেছিল পা টিপিয়া এই সিন্ধুতীরে।

অতলের পানে চাহি                নয়নে নিমেষ নাহি

        নীরবে দাঁড়ায়ে ছিল স্থির নতশিরে।

বহুকাল স্তব্ধ থাকি               শুনেছিল মুদে আঁখি

        এই মহাসমুদ্রের গীতি চিরন্তন;

তার পরে কৌতূহলে           ঝাঁপায়ে অগাধ জলে

        করেছিল এ অনন্ত রহস্য মন্থন।

বহুকাল দুঃখ সেবি                নিরখিল, লক্ষ্মীদেবী

        উদিলা জগৎ-মাঝে অতুল সুন্দর।

সেই সমুদ্রের তীরে                  শীর্ণ দেহে জীর্ণ চীরে

        খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।

        এতদিনে বুঝি তার ঘুচে গেছে আশ।

খুঁজে খুঁজে ফিরে তবু          বিশ্রাম না জানে কভু,

        আশা গেছে, যায় নাই খোঁজার অভ্যাস।

বিরহী বিহঙ্গ ডাকে               সারা নিশি তরুশাখে,

        যারে ডাকে তার দেখা পায় না অভাগা।

তবু ডাকে সারাদিন              আশাহীন শ্রান্তিহীন,

        একমাত্র কাজ তার ডেকে ডেকে জাগা।

আর-সব কাজ ভুলি            আকাশে তরঙ্গ তুলি

        সমুদ্র না জানি কারে চাহে অবিরত।

যত করে হায় হায়           কোনোকালে নাহি পায়,

        তবু শূন্যে তোলে বাহু, ওই তার ব্রত।

কারে চাহি ব্যোমতলে           গ্রহতারা লয়ে চলে,

        অনন্ত সাধনা করে বিশ্বচরাচর।

সেইমতো সিন্ধুতটে                ধূলিমাথা দীর্ঘজটে

        খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।

        একদা শুধাল তারে গ্রামবাসী ছেলে,

"সন্ন্যাসীঠাকুর, এ কী,         কাঁকালে ও কী ও দেখি,

        সোনার শিকল তুমি কোথা হতে পেলে।'

সন্ন্যাসী চমকি ওঠে               শিকল সোনার বটে,

        লোহা সে হয়েছে সোনা জানে না কখন।

একি কাণ্ড চমৎকার,            তুলে দেখে বার বার,

        আঁখি কচালিয়া দেখে এ নহে স্বপন।

কপালে হানিয়া কর               বসে পড়ে ভূমি-'পর,

        নিজেরে করিতে চাহে নির্দয় লাঞ্ছনা;

পাগলের মতো চায়--           কোথা গেল, হায় হায়,

        ধরা দিয়ে পলাইল সফল বাঞ্ছনা।

কেবল অভ্যাসমত                  নুড়ি কুড়াইত কত,

        ঠন্‌ ক'রে ঠেকাইত শিকলের 'পর,

চেয়ে দেখিত না, নুড়ি          দূরে ফেলে দিত ছুঁড়ি,

        কখন ফেলেছে ছুঁড়ে পরশ-পাথর।

        তখন যেতেছে অস্তে মলিন তপন।

আকাশ সোনার বর্ণ,              সমুদ্র  গলিত স্বর্ণ,

        পশ্চিম দিগ্বধূ দেখে সোনার স্বপন।

সন্ন্যাসী আবার ধীরে               পূর্বপথে যায় ফিরে

        খুঁজিতে নূতন ক'রে হারানো রতন।

সে শকতি নাহি আর                 নুয়ে পড়ে দেহভার

        অন্তর লুটায় ছিন্ন তরুর মতন।

পুরাতন দীর্ঘ পথ                 পড়ে আছে মৃতবৎ

        হেথা হতে কত দূর নাহি তার শেষ।

দিক হতে দিগন্তরে               মরুবালি ধূ ধূ করে,

        আসন্ন রজনী-ছায়ে ম্লান সর্বদেশ।

অর্ধেক জীবন খুঁজি              কোন্‌ ক্ষণে চক্ষু বুজি

        স্পর্শ লভেছিল যার এক পল ভর,

বাকি অর্ধ ভগ্ন প্রাণ              আবার করিছে দান

        ফিরিয়া খুঁজিতে সেই পরশ-পাথর।

মেঘের পরে মেঘ জমেছে

                                                     ------- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---গীতাঞ্জলি



মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে,

             আঁধার করে আসে,

আমায় কেন বসিয়ে রাখ

             একা দ্বারের পাশে।

                           কাজের দিনে নানা কাজে

                           থাকি নানা লোকের মাঝে,

                           আজ আমি যে বসে আছি

         তোমারি আশ্বাসে।

আমায় কেন বসিয়ে রাখ

            একা দ্বারের পাশে।

 

তুমি যদি না দেখা দাও,

            কর আমায় হেলা,

কেমন করে কাটে আমার

            এমন বাদল-বেলা।

    দূরের পানে মেলে আঁখি

    কেবল আমি চেয়ে থাকি,

                    পরান আমার কেঁদে বেড়ায়

        দুরন্ত বাতাসে।

আমায় কেন বসিয়ে রাখ

         একা দ্বারের পাশে।

ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা

                                             ------- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---বলাকা



ওরে  নবীন, ওরে আমার কাঁচা,

     ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,

     আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।

রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে

আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,

সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক'রে

     পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।

     আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

 

খাঁচাখানা দুলছে মৃদু হাওয়ায়;

     আর তো কিছুই নড়ে না রে

     ওদের ঘরে, ওদের ঘরের দাওয়ায়।

ওই যে প্রবীণ, ওই যে পরম পাকা,

চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা,

ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা

     অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায়।

     আয় জীবন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

 

বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ,

     দেখে না যে বাণ ডেকেছে

     জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ।

চলতে ওরা চায় না মাটির ছেলে

মাটির 'পরে চরণ ফেলে ফেলে,

আছে অচল আসনখানা মেলে

     যে যার আপন উচ্চ বাঁশের মাচায়,

     আয় অশান্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

 

তোরে হেথায় করবে সবাই মানা।

     হঠাৎ আলো দেখবে যখন

     ভাববে এ কী বিষম কাণ্ডখানা।

সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে,

শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে,

সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে

     লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়।

     আয় প্রচণ্ড, আয় রে আমার কাঁচা।

 

শিকল-দেবীর ওই যে পূজাবেদী

     চিরকাল কি রইবে খাড়া।

     পাগলামি তুই আয় রে দুয়ার ভেদি।

ঝড়ের মাতন, বিজয়-কেতন নেড়ে

অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে,

ভোলানাথের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে

     ভুলগুলো সব আন্‌ রে বাছা-বাছা।

     আয় প্রমত্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

 

আন্‌ রে টেনে বাঁধা-পথের শেষে।

     বিবাগী কর্‌ অবাধপানে,

     পথ কেটে যাই অজানাদের দেশে।

আপদ আছে, জানি অঘাত আছে,

তাই জেনে তো বক্ষে পরান নাচে,

ঘুচিয়ে দে ভাই পুঁথি-পোড়োর কাছে

     পথে চলার বিধিবিধান যাচা।

     আয় প্রমুক্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

 

চিরযুবা তুই যে চিরজীবী,

     জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে

     প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।

সবুজ নেশায় ভোর করেছি ধরা,

ঝড়ের মেঘে তোরি তড়িৎ ভরা,

বসন্তেরে পরাস আকুল-করা

     আপন গলার বকুল-মাল্যগাছা,

     আয় রে অমর, আয় রে আমার কাঁচা।

যে-কথা বলিতে চাই

                                         ------ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---বলাকা



যে-কথা বলিতে চাই,

         বলা হয় নাই,

             সে কেবল এই--

চিরদিবসের বিশ্ব আঁখিসম্মুখেই

             দেখিনু সহস্রবার

             দুয়ারে আমার।

     অপরিচিতের এই চির পরিচয়

এতই সহজে নিত্য ভরিয়াছে গভীর হৃদয়

     সে-কথা বলিতে পারি এমন সরল বাণী

          আমি নাহি জানি।

 

শূন্য প্রান্তরের গান বাজে ওই একা ছায়াবটে;

     নদীর এপারে ঢালু তটে

          চাষি করিতেছে চাষ;

     উড়ে চলিয়াছে হাঁস

ওপারের জনশূন্য তৃণশূন্য বালুতীরতলে।

          চলে কি না চলে

        ক্লান্তস্রোত শীর্ণ নদী, নিমেষ-নিহত

          আধো-জাগা নয়নের মতো।

          পথখানি বাঁকা

     বহুশত বরষের পদচিহ্ন-আঁকা

চলেছে মাঠের ধারে, ফসল-খেতের যেন মিতা,

     নদীসাথে কুটিরের বহে কুটুম্বিতা।

 

ফাল্গুনের এ-আলোয় এই গ্রাম, ওই শূন্য মাঠ,

              ওই খেয়াঘাট,

ওই নীল নদীরেখা, ওই দূর বালুকার কোলে

      নিভৃত জলের ধারে চখাচখি কাকলি-কল্লোলে

          যেখানে বসায় মেলা-- এই সব ছবি

              কতদিন দেখিয়াছে কবি।

শুধু এই চেয়ে দেখা, এই পথ বেয়ে চলে যাওয়া,

     এই আলো, এই হাওয়া,

এইমতো অস্ফুটধ্বনির গুঞ্জরণ,

     ভেসে-যাওয়া মেঘ হতে

     অকস্মাৎ নদীস্রোতে

          ছায়ার নিঃশব্দ সঞ্চরণ,

যে আনন্দ-বেদনায় এ জীবন বারেবারে করেছে উদাস

          হৃদয় খুঁজিছে আজি তাহারি প্রকাশ।

বিপদে মোরে রক্ষা করো

                                     ----- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---গীতাঞ্জলি



বিপদে মোরে রক্ষা করো

এ নহে মোর প্রার্থনা,

বিপদে আমি না যেন করি ভয়।

দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে

নাই বা দিলে সান্ত্বনা,

দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।

সহায় মোর না যদি জুটে

নিজের বল না যেন টুটে,

সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি

লভিলে শুধু বঞ্চনা

নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।


আমারে তুমি করিবে ত্রাণ

এ নহে মোর প্রার্থনা,

তরিতে পারি শকতি যেন রয়।

আমার ভার লাঘব করি

নাই বা দিলে সান্ত্বনা,

বহিতে পারি এমনি যেন হয়।

নম্রশিরে সুখের দিনে

তোমারি মুখ লইব চিনে,

দুখের রাতে নিখিল ধরা

যেদিন করে বঞ্চনা

তোমারে যেন না করি সংশয়।

অন্তর মম বিকশিত করো

                      ------ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---গীতাঞ্জলি

অন্তর মম বিকশিত করো
     অন্তরতর হে।
নির্মল করোউজ্জ্বল করো,
    সুন্দর কর হে।
           জাগ্রত করোউদ্যত করো,
                নির্ভয় করো হে।
      মঙ্গল করোনরলস নিঃসংশয় করো হে।
           অন্তর মম বিকশিত করো,
                অন্তরতর হে।

যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,
  মুক্ত করো হে বন্ধ,
সঞ্চার করো সকল মর্মে
  শান্ত তোমার ছন্দ।
      চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,
          নন্দিত করোনন্দিত করো,
              নন্দিত করো হে।
          অন্তর মম বিকশিত করো
               অন্তরতর হে।

জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা

                    ------- শামসুর রাহমান 

জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, অবসন্ন হাটুরের মতো বসে আছি

হাঁটু মুড়ে নগর ভেলায়।

এ এক প্রকৃত খেলা, এই ভেসে-যাওয়া তীরবর্তী শোভা দেখে,

জ্যোৎস্নার মাধ্যমে গড়ে তোলা মধুর সম্পর্ক কোনো

মহিলার সাথে।

বাতিল প্রেমিক যদি ফের খুঁজে পায় বেলাবেলি সম্প্রীতির ডেরা,

তাহ’লে সে নীলিমাকে জানিয়ে অভিবাদন, প্রায়

ফুরফুরে প্রজাপতি হয়ে উড়ে উড়ে অপরাহ্নে

ঘাসের অম্লান সবুজকে চুমু খেয়ে, হাত রেখে

খরগোশ অথবা কাঠবিড়ালীর পিঠে, হাত রেখে

খরগোশ অথবা কাঠবিড়ালীর পিঠে, দেয়ালের শ্যাওলায়

মগ্ন হবে গৃহপ্রবেশের সূরে এক লহমায়। কয়েক শতাব্দী তার

আঙুলে উঠবে নেচে, দেশলাই জ্বালালে আঁধারে

প্রাচীন দেয়ালচিত্র অকস্মাৎ হবে উন্মোচিত, বুঝিবা আহত হবে

কাতর হৃদয় তার অতীতের অসামাজিকতা হেতু আর

রাখবে সে চোখ টিকটিকি কিংবা বাতির ওপর।


জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, ঢাকাও মরাল হতে জানে

পূর্ণিমায়, দেখে নিই। যেন দরদালান সমেত যাচ্ছে উড়ে

দুলিয়ে বিপুল ডানা মগজের জ্যোৎস্নায় আমার।

ওলোট-পালোট কত স্মৃতি গোলাপের মতো ঝরে

এখন আমাকে ঘিরে, ঘ্রাণে নেশাতুর হয়ে পড়ি।

শৈশব কাঠের ঘোড়া চেপে আসে, যৌবনের খর দিনগুলি,

রাত্রিগুলি খুব মেশামেশি করে রক্ত কণিকায়,



চামর দোলায় কোন, অব্যক্ত তরুণী, তবু কিছু স্বেদচিহ্ন

থেকে যায় আমার এ শরীর-পেরুনো অন্য এক অবয়বে।

জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, আমিও ভাসছি ক্রমাগত।

জ্যোৎস্নায় ভাসছে, ঢাকা ওরা মৃত, ওরা পূর্বগামী পরিজন,

বুঝি ওরা বারংবার মরীচিকার চিৎকার শুনে

ছুটে গেছে, কোথায় যে মরুদ্যান প্রস্রবণ নিয়ে

আমন্ত্রণে উন্মুখর বেলা শেষে, করেনি খেয়াল। ওরা মৃত,

ভ্রান্তির গহ্বরে ওরা হারিয়ে ফেলেছে কণ্ঠস্বর।

দেখি প্লেগ-কবলিত শহরের মতো

ক্রুর অমাবস্যার এলাকা-

ছিন্নভিন্ন জামা, জীর্ণ জুতো পড়ে আছে ইতস্ততঃ

কাঁটাগুল্ম, পাথরের মধ্যে, ফুলের কেয়ারিগুলি ভরে ওঠে

পচা নাড়িভুড়ি আর হাড়গোড়ে। দেখি কতিপয়

ন্যাংটো লোক পথে

করছে বপন মৃত্যু,-আমি কি অসুস্থ হয়ে পড়ছি তাহ’লে?


আমার অসুখ বলে ঢাকা মন খারাপ করেছে।

ওর চোখে-মুখে বিষণ্নতা জেগে থাকে সারাক্ষণ,

যত বলি ফুল্ল স্বরে, ভেবোনা লক্ষ্মীটি, আমি খুব

তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবো, দেখে নিও,

তত সে খারাপ করে মন, চোখে জমে অশ্রুকণা,

আমার শিয়রে বসে থাকে ঠিক নার্সের ধরনে।

জ্যোৎস্নায় ভাসছো তুমি ঢাকা বেসামাল পূর্ণিমায়।

যাবো না স্বাস্থ্যের লোভে কোনো শৈলাবাসে,

তুমি আছি থেকো তুমি আমার অসুখ সেরে যাবে।

জ্বরদগ্ধ চোখে দেখি জ্যোৎস্না-ধোয়া স্নেহজাত পথ্য

তার হাতে নাচ আর রোজ নিয়ে আসে কিছু ফুল

রোগীর টেবিলে সুখ ফোটানোর অমল উদ্দেশ্যে।

আমার অস্তিত্ব থেকে অসুখের ছায়া সরে যাচ্ছে, দেখে যাও।

Friday, March 17, 2023

সৎপাত্র

 ___ সুকুমার রায়

শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে—

তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে ?

গঙ্গারামকে পাত্র পেলে ?

জানতে চাও সে কেমন ছেলে ?

মন্দ নয় সে পাত্র ভালো

রঙ যদিও বেজায় কালো ;

তার উপরে মুখের গঠন

অনেকটা ঠিক পেঁচার মতন ;

বিদ্যে বুদ্ধি ? বলছি মশাই—

ধন্যি ছেলের অধ্যবসায় !

উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে

ঘায়েল হয়ে থামল শেষে ।

বিষয় আশয় ? গরীব বেজায়—

কষ্টে–সৃষ্টে দিন চলে যায় ।


মানুষ তো নয় ভাইগুলো তার—

একটা পাগল একটা গোঁয়ার ;

আরেকটি সে তৈরী ছেলে,

জাল করে নোট গেছেন জেলে ।

কনিষ্ঠটি তবলা বাজায়

যাত্রাদলে পাঁচ টাকা পায় ।

গঙ্গারাম তো কেবল ভোগে

পিলের জ্বর আর পাণ্ডু রোগে ।

কিন্তু তারা উচ্চ ঘর,

কংসরাজের বংশধর !

শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের

কি যেন হয় গঙ্গারামের ।—

যহোক, এবার পাত্র পেলে,

এমন কি আর মন্দ ছেলে ?

ছাড়পত্র

 ___সুকান্ত ভট্টাচার্য

যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে

তার মুখে খবর পেলুমঃ

সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,

নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার

জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।

খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত

উত্তোলিত, উদ্ভাসিত

কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।

সে ভাষা বোঝে না কেউ,

কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।

আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা।

পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের

পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর

অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে

চলে যেতে হবে আমাদের।

চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

অবশেষে সব কাজ সেরে

আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে

করে যাব আশীর্বাদ,

তারপর হব ইতিহাস।।

যাত্রা-ভঙ্গ

 ___ নির্মলেন্দু গুণ

হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,

মন বাড়িয়ে ছুঁই,

দুইকে আমি এক করি না

এক কে করি দুই৷


হেমের মাঝে শুই না যবে,

প্রেমের মাঝে শুই

তুই কেমন করে যাবি?

পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া

আমাকেই তুই পাবি৷


তবুও তুই বলিস যদি যাই,

দেখবি তোর সমুখে পথ নাই৷


তখন আমি একটু ছোঁব,

হাত বাড়িয়ে জাড়াব তোর

বিদায় দুটি পায়ে,

তুই উঠবি আমার নায়ে,

আমার বৈতরনী নায়ে৷


নায়ের মাঝে বসব বটে,

না-এর মাঝে শোব৷

হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ,

দু:খ দিয়ে ছোঁব৷


তুই কেমন করে যাবি?

Tuesday, May 3, 2016

ঈশ্বর

_____কাজী নজরুল ইসলাম
কে তুমি খুঁজিছ জগদীশ ভাই আকাশ পাতাল জুড়ে’
কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?
       হায় ঋষি দরবেশ,
  বুকের মানিকে বুকে ধ’রে তুমি খোঁজ তারে দেশ-দেশ।
  সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,
  স্রষ্টারে খোঁজো-আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে!
  ইচ্ছা-অন্ধ! আঁখি খোলো, দেশ দর্পণে নিজ-কায়া,
  দেখিবে, তোমারি সব অবয়বে প’ড়েছে তাঁহার ছায়া।
  শিহরি’ উঠো না, শাস্ত্রবিদের ক’রো না ক’ বীর, ভয়-
তাহারা খোদার খোদ্‌ ‘প্রাইভেট সেক্রেটারী’ ত নয়!
সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি!
আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি!
রত্ন লইয়া বেচা-কেনা করে বণিক সিন্ধু-কুলে-
রত্নাকরের খবর তা ব’লে পুছো না ওদের ভুলে’।
   উহারা রত্ন-বেনে,
রত্ন চিনিয়া মনে করে ওরা রত্নাকরেও চেনে!
ডুবে নাই তা’রা অতল গভীর রত্ন-সিন্ধুতলে,
শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও, সখা, সত্য-সিন্ধু-জলে।


চলে যাব শুকনো পাতা-ছাওয়া ঘাসে

_____ জীবনানন্দ দাশ
চলে যাব শুকনো পাতা-ছাওয়া ঘাসে — জামরুল হিজলের বনে;
তলতা বাঁশের ছিপ হাতে রবে — মাছ আমি ধরিব না কিছু; —
দীঘির জলের গন্ধে রূপালি চিতল আর রূপসীর পিছু
জামের গভীর পাতা — মাখা শান — নীল জলে খেলিছে গোপনে;
আনারস ঝোপে ওই মাছরাঙা তার মাছরাঙাটির মনে
অস্পষ্ট আলোয় যেন মুছে যায় — সিঁদুরের মতো রাঙা লিচু
ঝড়ে পড়ে পাতা ঘাসে, — চেয়ে দেখি কিশোরী করেছে মাথা নিচু —
এসেছে সে দুপুরের অবসরে জামরুল লিচু আহরণে —

চলে যায়; নীলাম্বরী সরে যায় কোকিলের পাখনার মতো
ক্ষীরুয়ের শাখা ছুঁয়ে চালতার ডাল ছেড়ে বাঁশের পিছনে
কোনো দূর আকাঙ্খার ক্ষেতে মাঠে চলে যায় যেন অব্যহত,
যদি তার পিছে যাও দেখিবে সে আকন্দের করবীর বনে
ভোমরার ভয়ে ভীরু — বহু ক্ষণ পায়চারি করে আনমনে
তারপর চলে গেল : উড়ে গেল যেন নীল ভোমরার সনে।

বাঁশিওয়ালা

_____ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘ওগো বাঁশিওয়ালা,
    বাজাও তোমার বাঁশি,
        শুনি আমার নূতন নাম’-
এই বলে তোমাকে প্রথম চিঠি লিখেছি,
        মনে আছে তো?
আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে।
    সৃষ্টিকর্তা পুরো সময় দেন নি
        আমাকে মানুষ ক‘রে গড়তে,
        রেখেছেন আধাআধি করে।
অন্তরে বাহিরে মিল হয় নি-
    সেকালে আর আজকের কালে,
          মিল হয় নি ব্যথায় আর বুদ্ধিতে,
        মিল হয় নি শক্তিতে আর ইচ্ছায়।
আমাকে তুলে দেন নি এ যুগের পারানি নৌকোয়-
    চলা আটক করে ফেলে রেখেছেন,
        কালস্রোতের ও পারে বালুডাঙায়।

            সেখান থেকে দেখি
        প্রখর আলোয় ঝাপসা দূরের জগৎ;
বিনা কারণে কাঙাল মন অধীর হয়ে ওঠে;
    দুই হাত বাড়িয়ে দিই
নাগাল পাই নে কিছুই কোন দিকে।।

        বেলাতো কাটে না,
বসে থাকি জোয়ার-জলের দিকে চেয়ে-
ভেসে যায় মুক্তিপারের খেয়া,
    ভেসে যায় ধনপতির ডিঙা,
           ভেসে যায় চলতি বেলার আলোছায়া।
           এমন-সময় বাজে তোমার বাঁশি
            ভরা জীবনের সুরে,
            মরা দিনের নাড়ীর মধ্যে
    দব্দবিয়ে ফিরে আসে প্রাণের বেগ।।

কী বাজাও তুমি,
জানি নে সে সুর জাগায় কার মনে কী ব্যথা।
    বুঝি বাজাও পঞ্চম রাগে
দক্ষিণ হাওয়ার নবযৌবনের ভাটিয়ারি।
শুনতে শুনতে নিজেকে মনে হয়-
যে ছিল পাহাড়তলীর ঝিরঝিরে নদী
তার বুকে হঠাৎ উঠেছে ঘনিয়ে
শ্রাবণের বাদলরাত্রি।
সকালে উঠে দেখা যায় পাড়ি গেছে ভেসে,
একগুঁয়ে পাথরগুলোকে ঠেলা দিচ্ছে
অসহ্য স্রোতের ঘূর্ণিমাতন।।

আমার রক্তে নিয়ে আসে তোমার সুর
ঝড়ের ডাক, বন্যার ডাক,
আগুনের ডাক,
পাঁজরের-উপরে-আছাড়-খাওয়া
মরণসাগরের ডাক,
ঘরের-শিকল-নাড়া উদাসী হাওয়ার ডাক।
যেন হাঁক দিয়ে আসে
অপূর্ণের সংকীর্ণ খাদে
পূর্ণ স্রোতের ডাকাতি-
ছিনিয়ে নেবে, ভাসিয়ে দেবে বুঝি।
অঙ্গে অঙ্গে পাক দিয়ে ওঠে
কালবৈশাখীর-ঘূর্ণি-মার-খাওয়া অরণ্যের বকুনি।।

ডানা দেয় নি বিধাতা-
তোমার গান দিয়েছে আমার স্বপ্নে
ঝোড়ো আকাশে উড়ো প্রাণের পাগলামি।।

ঘরে কাজ করি শান্ত হয়ে;
সবাই বলে ‘ভালো’।
তারা দেখে আমার ইচ্ছার নেই জোর,
সাড়া নেই লোভের,
ঝাপট লাগে মাথার উপর-
ধূলোয় লুটোই মাথা।
দুরন্ত ঠেলায় নিষেধের পাহারা কাত ক’রে ফেলি
নেই এমন বুকের পাটা;
কঠিন করে জানি নে ভালোবাসতে,
কাঁদতে শুধু জানি,
জানি এলিয়ে পড়তে পায়ে।।

বাঁশিওয়ালা,
বেজে ওঠে তোমার বাঁশি,
ডাক পড়ে অমর্তলোকে;
সেখানে আপন গরিমায়
উপরে উঠেছে আমার মাথা।
সেখানে কুয়াশার পর্দা-ছেঁড়া
তরুণ সূর্য আমার জীবন।
সেখানে আগুনের ডানা মেলে দেয়
আমার বারণ-না-মানা আগ্রহ,
উড়ে চলে অজানা শূন্যপথে
প্রথম-ক্ষুধায়-অস্থির-গরুড়ের মতো।
জেগে ওঠে বিদ্রোহিনী,
তীক্ষè চোখের আড়ে জানায় ঘৃণা
চারদিকে ভীরুর ভিড়কে-
কৃশ কুটিলের কাপুরুষতাকে।।

বাঁশিওয়ালা,
হয়তো আমাকে দেখতে চেয়েছ তুমি।
জানি নে, ঠিক জায়গাটি কোথায়,
ঠিক সময় কখন,
চিনবে কেমন ক’রে।
দোসরহারা আষাঢ়ের ঝিল্লিঝণক রাত্রে
সেই নারীতো ছায়ারূপে
গেছে তোমার অভিসারে
চোখ-এড়ানো পথে।
সেই অজানাকে কত বসন্তে
পরিয়েছ ছন্দের মালা-
শুকোবে না তার ফুল।।

তোমার ডাক শুনে একদিন
ঘরপোষা নির্জীব মেয়ে
অন্ধকার কোণ থেকে বেরিয়ে এল ঘোমটা খসা নারী।
যেন সে হঠাৎ-গাওয়া নতুন ছন্দ বাল্মীকির,
চমক লাগালো তোমাকেই।
সে নামবে না গানের আসন থেকে;
সে লিখবে তোমাকে চিঠি
রাগিনীর আবছায়ায় বসে-
তুমি জানবে না তার ঠিকানা।
ওগো বাঁশিওয়ালা,
সে থাক তোমার বাঁশির সুরের দূরত্বে।

Tuesday, March 22, 2016

মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম

_____কাজী নজরুল ইসলাম
মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম 
মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল, 
মোরা বিধাতার মত নির্ভয় 
মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।। 
মোরা আকাশের মত বাঁধাহীন 
মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন, 
বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন 
চিত্তমুক্ত শতদল।। 
মোরা সিন্ধু জোঁয়ার কলকল 
মোরা পাগলা জোঁয়ার ঝরঝর। 
কল-কল-কল, ছল-ছল-ছল 
মোরা দিল খোলা খোলা প্রান্তর, 
মোরা শক্তি অটল মহীধর। 
হাসি গান শ্যাম উচ্ছল 
বৃষ্টির জল বনফল খাই- 
শয্যা শ্যামল বনতল।।

হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক

____কাজী নজরুল ইসলাম
হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই
ভারতের দুই আঁখি তারা
এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা।।

যেন গঙ্গা সিন্ধু নদী
যায় গো বয়ে নিরবধি
এক হিমালয় হতে আসে, এক সাগরে হয় গো হারা।।

বুলবুল আর কোকিল পাখী
এক কাননে যায় গো ডাকি,
ভাগীরথী যমুনা বয় মায়ের চোখের যুগল ধারা।।

ঝগড়া করে ভায়ে ভায়ে
এক জননীর কোল লয়ে
মধুর যে এ কলহ ভাই পিঠোপিঠী ভায়ের পারা।।

পেটে ধরা ছেলের চেয়ে চোখে ধরারা মায়া বেশী,
অতিথী ছিল অতীতে, আজ সে সখা প্রতিবেশী।
ফুল পাতিয়ে গোলাপ বেলী
একই মায়ের বুকে খেলি,
পাগলা তা'রা আল্লা ভগবানে ভাবে ভিন্ন যারা।।

সাম্যবাদী

_____ কাজী নজরুল ইসলাম
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্‌ফুসিয়াস্‌? চার্বআখ চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত সখ-
কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃষয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!

বন্ধু, বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
এই হৃদ্য়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম্‌ এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মস্‌জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান,
এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।

সকিনা

_____জসীমউদদীন
দুখের সায়রে সাঁতারিয়া আজ সকিনার তরীখানি,
ভিড়েছে যেখানে, সেতা নাই কূল, শুধুই অগাধ পানি।
গরীবের ঘরে জন্ম তাহার, বয়স বাড়িতে হায়,
কিছু বাড়িল না, একরাশ রূপ জড়াইল শুধু গায়।
সেই রূপই তার শত্রু হইল, পন্যের মত তারে,
বিয়ে দিল বাপ দুই মুঠি ভরি টাকা আধুলির ভারে!

খসম তাহার দাগী-চোর, রাতে রহিত না ঘরে,
হেথায় হোথায় ঘুরিয়া ফিরিত সিদকাঠি হাতে করে।
সারাটি দিবস পড়িয়া ঘুমাত, সকিনার সনে তার,
দেখা যে হইত ক্ষনেকের তরে, মাসে দুই একবার।
সেই কোন তার কল্পিত এক এপরাধ ভেবে মনে,
মারিবার যবে হত প্রয়োজন অতীব ক্রোধের সনে।
এমন স্বামীর বন্ধন ছাড়ি বহু হাত ঘুরি ফিরি,
দুঃখের জাল মেলে সে চলিল জীবনের নদী ঘিরি।
সে সব কাহিনী বড় নিদারুন, মোড়লের দরবার,
উকিলের বাড়ি, থানার হাজত, রাজার কাছারী আর;
ঘন পাট ক্ষেত, দূর বেত ঝাড়, গহন বনের ছায়,
সাপের খোড়লে, বাঘের গুহায় কাটাতে হয়েছে তায়;
দিনেরে লুকায়ে, রাতেরে লুকায়ে সে সব কাহিনী তার,
লিখে সে এসেছে, কেউ কোন দিন জানিবে না সমাচার।
সে কেচ্ছা কোন কবি গাহিবে না কোন দেশে কোন কালে,
সকিনারি শুদা সারাটি জনম দহিবে যে জঞ্জালে।
এত যে আঘাত, এত অপমান, এত লাঞ্ছনা তার,
সবই তার মনে, এতটুকু দাগ লাগে নাই দেহে তার।
দেহ যে তার পদ্মের পাতা, ঘটনার জল-দল,
গড়ায়ে পড়িতে রূপেরে করেছে আরো সে সমুজ্জল।

সে রূপ যাদের টানিয়া আনিল তারা দুই হাত দিয়ে,
জগতের যত জঞ্জাল আনিল জড়াইল তারে নিয়ে।
কেউ দিল তারে বিষের ভান্ড, কেউ বা প্রবঞ্চনা,
কেউ দিল ঘৃণা, কলঙ্ক কালি এনে দিল কোন জনা।
সে রূপের মোহে পতঙ্গ হয়ে যাহারা ভিড়িল হায়,
তারা পুড়িল না অমর করিয়া বিষে বিষাইল তায়।
তাদেরি সঙ্গে আসিল যুবক, তরুণ সে জমিদার,
হাসিখুশী মুখ, সৌম্য মুরতি দেশ-জোড়া খ্যাতি তার।
সে আসি বলিল, সব গ্লানি হতে তোমারে মুক্ত করি,
মোর গৃহে নিয়ে রাণীর বেশেতে সাজাইব এই পরী।
করিলও তাই, যে জাল পাতিয়া রূপ-পিয়াসীর দল,
রেখেছিল তারে বন্দী করিয়া রচিয়া নানান ছল;
সে সব হইতে টানিয়া তাহারে নিয়ে এলো করি বার,
গত জীবনের মুছিয়া ঘটনা জীবন হইতে তার!
মেঘ-মুক্ত সে আকাশের মত দাঁড়াল যখন এসে,
রূপ যেন তারে করিতেছে স্তব সারটি অঙ্গে ভেসে।

পুরান পুকুর

______জসীমউদদীন
পুরান পুকুর, তব তীরে বসি ভাবিয়া উদাস হই,
খেজুরের গোড়ে বাঁধা ছোট ঘাট, করে জল থই থই;
রাত না পোহাতে গাঁয়ের বধুরা কলসীর কলরবে,
ঘুম হতে তোমা জাগাইয়া দিত প্রভাতের উৎসবে।
সারাদিন ধরি ঘড়ায় ঘড়ায় তব অমৃতরাশি,
বধুদের কাঁখে ঢলিয়া ঢলিয়া ঘরে ঘরে যেত হাসি।
‘বদনায়'ভরা একটুকু, তারি ভরসায় গেঁয়ো-চাষী,
চৈত্র-রোদের করুণ করিয়া বাজাত গানের বাঁশী।
মাঠ হতে তারা জ্বলিয়া পুড়িয়া আসিত তোমার তীরে,
খেজুর পাতায় সোনালী চামর দোলাতে তাদের শিরে।
শান্ত হইয়া গামছা ভিজায়ে তোমার কাজল-জলে,
নাহিয়া নাহিয়া সাধ মিটিত না-আবার নাহিবে বলে।
এইখানে বসি পল্লী-বধূরা আধেক ঘোমটা খুলি,
তোমার মুকুরে মুখখানি হেরে জল-ভরা যেত ভুলি।
সখিতে সখিতে কাঁধে কাঁধ ধরি খেলিত যে জল-খেলা,
সারাটি গাঁয়ের যত রূপ আছে তব বুকে হত মেলা,
পুকুরের জল উথলি পাথালি ভাসিত তাদের হাসি, -
ফুলে ফুল লাগি ফুলেরা যেমন ভেঙে হয় রাশি রাশি।
আজি মনে পড়ে, পুরান পুকুর, মায়ের আঁচল ধরে,
একটি ছেলের ঝাঁপাঝাঁপি খেলা তোমার বুকের পরে।
ওই এত জলে সাঁপলার ফুল, -তারি ছিল এত লোভ,
তাই তুলিবারে জলে ডুবিলেও মনে নাহি ছিল ক্ষোভ।
আজিকে তোমার কোথায় সে জল? কোথা সেই বাঁধা ঘাট,
গেঁয়ো বধূদের খাড়ুতে মুখর কোথা সে পুকুর বাট?
চারিধারে তব বন-জঙ্গল পাতায় পাতায় ঢাকা,
নিকষ-রাতের আঁধার যেন গো তুলিতে রয়েছে আঁকা।
ডুকরিয়া কাঁদে ডাহুক ডাহুকী তরু-মর্ম্মর স্বনে,
তারি সাথে বুঝি উঠিছে শিহরি যত ব্যথা তব মনে!
হিজল গাছের মালা হতে আজি খসিয়া রঙিন ফুল,
সাঁঝের মতন দিতেছে ব্যথিয়া তোমার চরণমূল।
সন্ধ্যা-সকালে আসিত যাহারা কলসী লইয়া ঘাটে,
তারা সবে আজি বিদায় নিয়েছে মরণ পারের হাটে।
বক্ষ-মুকুরে সোনা মুখখানি দেখিবারে কেহ নাই,
কুচুরী পানায় আধ বুকখানি ঢাকিয়া রেখেছ তাই!
ঘুচাও ঘুচাও মৌন তড়াগ, বুকের আরসীখানি,
মোর বাল্যের যত ভুলো-কথা সারা গায়ে দাও টানি।
সেই ছেলেবেলা স্বপ্নের মত কত স্নেহ ভরা মুখ,
এনে দাও, শুধু বারেক দেখিয়া ভরে লই সারা বুক।
এনে দাও সেই তব তীরে বসি মেঠো রাখালের বাঁশী
স্বপনের ভেলা দুলায়ে দুলায়ে আকাশেতে যাক্ ভাসি।
হায়রে, সেদিন আসে না ফিরিয়া! শুধু ভিজে আঁখি পাতা,
পুরানো স্বপন কুড়ায়ে কুড়ায়ে আকাশেতে জাল পাতা!
তুমিও সজনি, আমারি মতন না জানি কাঁদিছ কত,
ছোট ঢেউগুলি নাড়িয়া নাড়িয়া পাড়েরে করিছ ক্ষত।
বনদেবী আজ সমবেদনায় আঁচল বিছায়ে জলে,
ব্যথাতুরা তব সারা বুকখানি ঢেকেছে কলমী দলে।

Tuesday, February 16, 2016

ও মেয়ে

_____ শতাব্দী রায়।।
.
ও মেয়ে তোর বয়স কত?
: কি জানি গো,মা থাকলে বলে দিত।
সেই যে বারে দাঙ্গা হল,শয়ে শয়ে লোক
মরল,
হিন্দুদের ঘর জ্বলল, মুসলমানের রক্ত ঝরল,
তখন নাকি মা পোয়াতি,দাঙ্গা আমার
জন্মতিথি।
ও মেয়ে তোর বাবা কোথায়?
: মা বলেছে,গরিব দের বাবা হারায়
কেউ তো বলে বাপটা আমার হারামি ছিল।
মায়ের জীবন নষ্ট করে,অন্য গাঁয়ে ঘর বাঁধল।
মা বলত, শিবের দয়াই তোকে পেলাম,
শিবকেই তাই বাপ ডাকলাম।
ও মেয়ে তোর প্রেমিক আছে?
ছেলেরা ঘোরে ধারে-কাছে?
: প্রেমিক কি গো?মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে?
স্বপ্ন দেখাই দিন দুপুরে?
চুড়ি কাজল মেলাতে কেনায়,
ঝোপের ধারে জামা খোলায়?
এসব নন্দ কাকা করেছে দুবার
প্রেমিক ওকেই বলব এবার।
ও মেয়ে তোর পদবি কি?
: বাপই নাকি দেয় শুনেছি
পদবী থাকলে ভাত পাওয়া যায়?
বাপের আদর কাঁদায় হাসায়
ওটা কি বাজারে মেলে?
কিনব তবে দু-দশে দিলে
দামী হলে চাই না আমার
থাক তবে ও বাপ-ঠাকুরদার
ও মেয়ে তুই রূপসী?
:লোকে বলে ডাগর গতর সর্বনাশী
রুপ তো নয়, চোখের ধাঁধা।
যৌবনেতে কুকুরী রাঁধা।
পুরুষ চোখের ইশারা আসে,
সুযোগ বুঝে বুকে পাছায় হাত ও ঘষে।
রুপ কি শুধুই মাংসপেশী?
তবে তো আমি খুব রূপসী।
ও মেয়ে তোর ধর্ম কি রে?
: মেয়েমানুষের ধর্ম কি গো?
সব কিছু তো শরীর ঘিরে,
সালমা বলে ধর্মই সমাজ বানায়,
সন্ধেবেলা যখন দাঁড়াই
কেউ তো বলে না,হিন্দু নাকি?
সবাই বলে,কতই যাবি?
বিছানা নাকি ধর্ম মেলায়
শরীর যখন শরীর খেলায়
তাই ভাবছি এবার থেকে ধর্ম বলব শরীর বা বিছানাকে।