Sunday, August 16, 2015

আত্মবিলাপ

আত্মবিলাপ
       ----- মাইকেল মধুসূদন দত্ত

আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু,হায়,
তাই ভাবী মনে?
জীবন-প্রবাহ বহি কাল-সিন্ধু পানে যায়,
ফিরাব কেমনে?
দিন দিন আয়ুহীন হীনবল দিন দিন ,—
তবু এ আশার নেশা ছুটিল না? এ কি দায়!
রে প্রমত্ত মন মম! কবে পোহাইবে রাতি?
জাগিবি রে কবে?
জীবন-উদ্যানে তোর যৌবন-কুসুম-ভাতি
কত দিন রবে?
নীর বিন্ধু, দূর্বাদলে,নিত্য কিরে ঝলঝলে?
কে না জানে অম্বুবিম্ব অম্বুমুখে সদ্যঃপাতি?
নিশার স্বপন-সুখে সুখী যে কী সুখ তার?
জাগে সে কাঁদিতে!
ক্ষণপ্রভা প্রভা -দানে বাড়ায় মাত্ত আঁধার
পথিকে ধাঁদিতে!
মরীচিকা মরুদেশে,নাশে প্রাণ তৃষাক্লেশে—
এ তিনের ছল সম ছল রে এ কু-আশার।
প্রেমের নিগড় গড়ি পরিলি চরণে সাদে
কী ফল লভিলি?
জ্বলন্ত-পাবক-শিখা-লোভে তুই কাল ফাঁদে
উড়িয়া পড়িলি
পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়,ধাইলি,অবোধ,হায়
না দেখলি না শুনিলি,এবে রে পরাণ কাঁদে
বাকি কি রাখিলি তুই বৃথা অর্থ-অন্বেষণে,
সে সাধ সাধিতে?
ক্ষত মাত্ত হাত তোর মৃণাল-কণ্টকগণে
কমল তুলিতে
নারিলি হরিতে মণি, দঃশিল কেবল ফণী
এ বিষম বিষজ্বালা ভুলিবি, মন,কেমনে!
যশোলাভ লোভে আয়ু কত যে ব্যয়িলি হায়,
কব তা কাহারে?
সুগন্ধ কুসুম-গন্ধে অন্ধ কীট যথা ধায়,
কাটিতে তাহারে?
মাৎসর্য-বিষদশন, কামড়ে রে অনুক্ষণ!
এই কি লভিলি লাভ,অনাহারে,অনিদ্রায়?
মুকুতা-ফলের লোভে,ডুবে রে অতল জলে
যতনে ধীবর,
শতমুক্তাধিক আয়ু কালসিন্ধু জলতলে
ফেলিস,পামড়!
ফিরি দিবি হারাধন,কে তোরে,অবোধ মন,
হায় রে,ভুলিবি কত আশার কুহক-ছলে!

বঙ্গভাষা

বঙ্গভাষা
        ---- মাইকেল মধুসূদন দত্ত

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;--
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!
অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;--
কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন!

স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে, --
"ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে।"
পালিলাম আজ্ঞা সুখে' পাইলাম কালে
মাতৃভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে‍‍‍‍‍‍‍‍‍‌‌‌।।

কপোতাক্ষ নদ

কপোতাক্ষ নদ
            ------ মাইকেল মধুসূদন দত্ত

সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।
সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে
দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।
আর কি হে হবে দেখা যত দিন যাবে
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি রূপ কর তুমি এ মিনতি গাবে
বঙ্গজ জনের কানে সখে-সখারিতে।
নাম তার এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে
লইছে যে নাম তব বঙ্গের সঙ্গীতে।

প্রথম সর্গ (মেঘনাদবধ কাব্য)

প্রথম সর্গ (মেঘনাদবধ কাব্য)
                       ---- মাইকেল মধুসূদন দত্ত

সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি,
কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি
রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা
ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদে — অজেয় জগতে —
ঊর্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা?
বন্দি চরণারবিন্দ, অতি মন্দমতি
আমি, ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভুজে
ভারতি! যেমতি, মাতঃ, বসিলা আসিয়া,
বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন)
যবে খরতর শরে, গহন কাননে,
ক্রৌঞ্চবধূ সহ ক্রৌঞ্চে নিষাদ বিঁধিলা,
তেমতি দাসেরে, আসি, দয়া কর, সতি।
কে জানে মহিমা তব এ ভবমণ্ডলে?
নরাধম আছিল যে নর নরকুলে
চৌর্যে রত, হইল সে তোমার প্রসাদে,
মৃ্ত্যুঞ্জয়, যথা মৃত্যুঞ্জয় উমাপতি!
হে বরদে, তব বরে চোর রত্নাকর
কাব্যরত্নাকর কবি! তোমার পরশে,
সুচন্দন-বৃক্ষশোভা বিষবৃক্ষ ধরে!
হায়, মা, এহেন পুণ্য আছে কি এ দাসে?
কিন্তু যে গো গুণহীন সন্তানের মাঝে
মূঢ়মতি, জননীর স্নেহ তার প্রতি
সমধিক। ঊর তবে, ঊর দয়াময়ি
বিশ্বরমে! গাইব, মা, বীররসে ভাসি,
মহাগীত; ঊরি, দাসে দেহ পদছায়া।
— তুমিও আইস, দেবি তুমি মধুকরী
কল্পনা! কবির ঢিত্ত-ফুলবন-মধু
লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে
আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।

কনক-আসনে বসে দশানন বলী —
হেমকূট-হৈমশিরে শৃঙ্গবর যথা
তেজঃপুঞ্জ। শত শত পাত্রমিত্র আদি
সভাসদ, নতভাবে বসে চারি দিকে।
ভূতলে অতুল সভা — স্ফটিকে গঠিত;
তাহে শোভে রত্নরাজি, মানস-সরসে
সরস কমলকুল বিকশিত যথা।
শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত, স্তম্ভ সারি সারি
ধরে উচ্চ স্বর্ণছাদ, ফণীন্দ্র যেমতি,
বিস্তারি অযুত ফণা, ধরেন আদরে
ধরারে। ঝুলিছে ঝলি ঝালরে মুকুতা,
পদ্মরাগ, মরকত, হীরা; যথা ঝোলে
(খচিত মুকুলে ফুল) পল্লবের মালা
ব্রতালয়ে। ক্ষণপ্রভা সম মুহুঃ হাসে
রতনসম্ভবা বিভা — ঝলসি নয়নে!
সুচারু চামর চারুলোচনা কিঙ্করী
ঢুলায়; মৃণালভুজ আনন্দে আন্দোলি
চন্দ্রাননা। ধরে ছত্র ছত্রধর; আহা
হরকোপানলে কাম যেন রে না পুড়ি
দাঁড়ান সে সভাতলে ছত্রধর-রূপে!—
ফেরে দ্বারে দৌবারিক, ভীষণ মুরতি,
পাণ্ডব-শিবির দ্বারে রুদ্রেশ্বর যথা
শূলপাণি! মন্দে মন্দে বহে গন্ধে বহি,
অনন্ত বসন্ত-বায়ু, রঙ্গে সঙ্গে আনি
কাকলী লহরী, মরি! মনোহর, যথা
বাঁশরীস্বরলহরী গোকুল বিপিনে!
কি ছার ইহার কাছে, হে দানবপতি
ময়, মণিময় সভা, ইন্দ্রপ্রস্থে যাহা
স্বহস্তে গড়িলা তুমি তুষিতে পৌরবে?

এহেন সভায় বসে রক্ষঃকুলপতি,
বাক্যহীন পুত্রশোকে! ঝর ঝর ঝরে
অবিরল অশ্রুধারা — তিতিয়া বসনে,
যথা তরু, তীক্ষ্ণ শর সরস শরীরে
বাজিলে, কাঁদে নীরবে। কর জোড় করি,
দাঁড়ায় সম্মুখে ভগ্নদূত, ধূসরিত
ধূলায়, শোণিতে আর্দ্র সর্ব কলেবর।
বীরবাহু সহ যত যোধ শত শত
ভাসিল রণসাগরে, তা সবার মাঝে
একমাত্র বাঁচে বীর; যে কাল তরঙ্গ
গ্রাসিল সকলে, রক্ষা করিল রাক্ষসে—
নাম মকরাক্ষ, বলে যক্ষপতি সম।
এ দূতের মুখে শুনি সুতের নিধন,
হায়, শোকাকুল আজি রাজকুলমণি
নৈকষেয়! সভাজন দুঃখী রাজ-দুঃখে।
আঁধার জগৎ, মরি, ঘন আবরিলে
দিননাথে! কত ক্ষণে চেতন পাইয়া,
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি, কহিলা রাবণ;—

“নিশার স্বপনসম তোর এ বারতা,
রে দূত! অমরবৃন্দ যার ভুজবলে
কাতর, সে ধনুর্ধরে রাঘব ভিখারী
বধিল সম্মুখ রণে? ফুলদল দিয়া
কাটিলা কি বিধাতা শাল্মলী তরুবরে?
হা পুত্র, হা বীরবাহু, বীর-চূড়ামণি!
কি পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে?
কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি,
হরিলি এ ধন তুই? হায় রে, কেমনে
সহি এ যাতনা আমি? কে আর রাখিবে
এ বিপুল কুল-মান এ কাল সমরে!
বনের মাঝারে যথা শাখাদলে আগে
একে একে কাঠুরিয়া কাটি, অবশেষে
নাশে বৃক্ষে, হে বিধাতঃ, এ দুরন্ত রিপু
তেমতি দুর্বল, দেখ, করিছে আমারে
নিরন্তর! হব আমি নির্মূল সমূলে
এর শরে! তা না হলে মরিত কি কভু
শূলী শম্ভুসম ভাই কুম্ভকর্ণ মম,
অকালে আমার দোষে? আর যোধ যত—
রাক্ষস-কুল-রক্ষণ? হায়, সূর্পণখা,
কি কুক্ষণে দেখেছিলি, তুই অভাগী,
কাল পঞ্চবটীবনে কালকূটে ভরা
এ ভুজগে? কি কুক্ষণে (তোর দুঃখে দুঃখী)
পাবক-শিখা-রূপিণী জানকীরে আমি
আনিনু এ হৈম গেহে? হায় ইচ্ছা করে,
ছাড়িয়া কনকলঙ্কা, নিবিড় কাননে
পশি, এ মনের জ্বালা জুড়াই বিরলে!
কুসুমদাম-সজ্জিত, দীপাবলী-তেজে
উজ্জ্বলিত নাট্যশালা সম রে আছিল
এ মোর সুন্দরী পুরী! কিন্তু একে একে
শুখাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটি;
নীরব রবাব, বীণা, মুরজ, মুরলী;
তবে কেন আর আমি থাকি রে এখানে?
কার রে বাসনা বাস করিতে আঁধারে?”

এইরূপে বিলাপিলা আক্ষেপে রাক্ষস–
কুলপতি রাবণ; হায় রে মরি, যথা
হস্তিনায় অন্ধরাজ, সঞ্জয়ের মুখে
শুনি, ভীমবাহু ভীমসেনের প্রহারে
হত যত প্রিয়পুত্র কুরুক্ষেত্র-রণে!

তবে মন্ত্রী সারণ (সচিবশ্রেষ্ঠ বুধঃ)
কৃতাঞ্জলিপুটে উঠি কহিতে লাগিলা
নতভাবে; — “হে রাজন্, ভুবন বিখ্যাত,
রাক্ষসকুলশেখর, ক্ষম এ দাসেরে!
হেন সাধ্য কার আছে বুঝায় তোমারে
এ জগতে? ভাবি, প্রভু দেখ কিন্তু মনে;—
অভ্রভেদী চূড়া যদি যায় গুঁড়া হয়ে
বজ্রাঘাতে, কভু নহে ভূধর অধীর
সে পীড়নে। বিশেষতঃ এ ভবমণ্ডল
মায়াময়, বৃথা এর দুঃখ সুখ যত।
মোহের ছলনে ভুলে অজ্ঞান যে জন।”

উত্তর করিলা তবে লঙ্কা-অধিপতি;—
“যা কহিলে সত্য, ওহে অমাত্য-প্রধান
সারণ! জানি হে আমি, এ ভব-মণ্ডল
মায়াময়, বৃথা এর দুঃখ সুখ যত।
কিন্তু জেনে শুনে তবু কাঁদে এ পরাণ
অবোধ। হৃদয়-বৃন্তে ফুটে যে কুসুম,
তাহারে ছিঁড়িলে কাল, বিকল হৃদয়
ডোবে শোক-সাগরে, মৃণাল যথা জলে,
যবে কুবলয়ধন লয় কেহ হরি।”

এতেক কহিয়া রাজা, দূত পানে চাহি,
আদেশিলা,— “কহ, দূত, কেমনে পড়িল
সমরে অমর-ত্রাস বীরবাহু বলী?”

প্রণমি রাজেন্দ্রপদে, করযুগ জুড়ি,
আরম্ভিলা ভগ্নদূত;— “হায়, লঙ্কাপতি,
কেমনে কহিব আমি অপূর্ব কাহিনী?
কেমনে বর্ণিব বীরবাহুর বীরতা?—
মদকল করী যথা পশে নলবনে,
পশিলা বীরকুঞ্জর অরিদল মাঝে
ধনুর্ধর। এখনও কাঁপে হিয়া মম
থরথরি, স্মরিলে সে ভৈরব হুঙ্কারে!
শুনেছি, রাক্ষসপতি, মেঘের গর্জনে;
সিংহনাদে; জলধির কল্লোলে; দেখেছি
দ্রুত ইরম্মদে, দেব, ছুটিতে পবন–
পথে; কিন্তু কভু নাহি শুনি ত্রিভুবনে,
এহেন ঘোর ঘর্ঘর কোদণ্ড-টঙ্কারে!
কভু নাহি দেখি শর হেন ভয়ঙ্কর!—

পশিলা বীরেন্দ্রবৃন্দ বীরবাহু সহ
রণে, যূথনাথ সহ গজযূথ যথা।
ঘন ঘনাকারে ধূলা উঠিল আকাশে,—
মেঘদল আসি যেন আবরিলা রুষি
গগনে; বিদ্যুৎঝলা-সম চকমকি
উড়িল কলম্বকুল অম্বর প্রদেশে
শনশনে!— ধন্য শিক্ষা বীর বীরবাহু!
কত যে মরিল অরি, কে পারে গণিতে?

এইরূপে শত্রুমাঝে যুঝিলা স্বদলে
পুত্র তব, হে রাজন্! কত ক্ষণ পরে,
প্রবেশিলা, যুদ্ধে আসি নরেন্দ্র রাঘব।
কনক-মুকুট শিরে, করে ভীম ধনুঃ,
বাসবের চাপ যথা বিবিধ রতনে
খচিত,”— এতেক কহি, নীরবে কাঁদিল
ভগ্নদূত, কাঁদে যথা বিলাপী, স্মরিয়া
পূর্বদুঃখ! সভাজন কাঁদিলা নীরবে।

অশ্রুময়-আঁখি পুনঃ কহিলা রাবণ,
মন্দোদরীমনোহর;— “কহ, রে সন্দেশ–
বহ, কহ, শুনি আমি, কেমনে নাশিলা
দশাননাত্মজ শূরে দশরথাত্মজ?”
“কেমনে, হে মহীপতি,” পুনঃ আরম্ভিল
ভগ্নদূত, “কেমনে, হে রক্ষঃকুলনিধি,
কহিব সে কথা আমি, শুনিবে বা তুমি?
অগ্নিময় চক্ষুঃ যথা হর্যক্ষ, সরোষে
কড়মড়ি ভীম দন্ত, পড়ে লম্ফ দিয়া
বৃষস্কন্ধে, রামচন্দ্র আক্রমিলা রণে
কুমারে! চৌদিকে এবে সমর-তরঙ্গ
উথলিল, সিন্ধু যথা দ্বন্দ্বি বায়ু সহ
নির্ঘোষে! ভাতিল অসি অগ্নিশিখাসম
ধূমপুঞ্জসম চর্মাবলীর মাঝারে
অযুত! নাদিল কম্বু অম্বুরাশি-রবে!—
আর কি কহিব, দেব? পূর্বজন্মদোষে,
একাকী বাঁচিনু আমি! হায় রে বিধাতঃ,
কি পাপে এ তাপ আজি দিলি তুই মোরে?
কেন না শুইনু আমি শরশয্যোপরি,
হৈমলঙ্কা-অলঙ্কার বীরবাহু সহ
রণভূমে? কিন্তু নহি নিজ দোষে দোষী।
ক্ষত বক্ষঃস্থল মম, দেখ, নৃপমণি,
রিপু-প্রহরণে; পৃষ্ঠে নাহি অস্ত্রলেখা।”
এতেক কহিয়া স্তব্ধ হইল রাক্ষস
মনস্তাপে। লঙ্কাপতি হরষে বিষাদে
কহিলা; “সাবাসি, দূত! তোর কথা শুনি,
কোন্ বীর-হিয়া নাহি চাহে রে পশিতে
সংগ্রামে? ডমরুধ্বনি শুনি কাল ফণী
কভু কি অলসভাবে নিবাসে বিবরে?
ধন্য লঙ্কা, বীরপুত্রধারী! চল, সবে,—
চল যাই, দেখি, ওহে সভাসদ-জন,
কেমনে পড়েছে রণে বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু; চল, দেখি জুড়াই নয়নে।”

উঠিলা রাক্ষসপতি প্রাসাদ-শিখরে,
কনক-উদয়াচলে দিনমণি যেন
অংশুমালী। চারিদিকে শোভিল কাঞ্চন-
সৌধ-কিরীটিনী লঙ্কা— মনোহরা পুরী!
হেমহর্ম্য সারি সারি পুষ্পবন মাঝে;
কমল-আলয় সরঃ; উৎস রজঃ-ছটা;
তরুরাজি; ফুলকুল— চক্ষু-বিনোদন,
যুবতীযৌবন যথা; হীরাচূড়াশিরঃ
দেবগৃহ; নানা রাগে রঞ্জিত বিপণি,
বিবিধ রতনপূর্ণ; এ জগৎ যেন
আনিয়া বিবিধ ধন, পূজার বিধানে,
রেখেছে, রে চারুলঙ্কে, তোর পদতলে,
জগত-বাসনা তুই, সুখের সদন।

দেখিলা রাক্ষসেশ্বর উন্নত প্রাচীর—
অটল অচল যথা; তাহার উপরে,
বীরমদে মত্ত, ফেরে অস্ত্রীদল, যথা
শৃঙ্গধরোপরি সিংহ। চারি সিংহদ্বার
(রুদ্ধ এবে) হেরিলা বৈদেহীহর; তথা
জাগে রথ, রথী, গজ, অশ্ব, পদাতিক
অগণ্য। দেখিলা রাজা নগর বাহিরে,
রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ সিন্ধুতীরে যথা,
নক্ষত্র-মণ্ডল কিম্বা আকাশ-মণ্ডলে।
থানা দিয়া পূর্ব দ্বারে, দুর্বার সংগ্রামে,
বসিয়াছে বীর নীল; দক্ষিণ দুয়ারে
অঙ্গদ, করভসম নব বলে বলী;
কিংবা বিষধর, যবে বিচিত্র কঞ্চুক-
ভূষিত, হিমান্তে অহি ভ্রমে, ঊর্ধ্ব ফণা—
ত্রিশূলসদৃশ জিহ্বা লুলি অবলেপে!
উত্তর দুয়ারে রাজা সুগ্রীব আপনি
বীরসিংহ। দাশরথি পশ্চিম দুয়ারে—
হায় রে বিষণ্ণ এবে জানকী-বিহনে,
কৌমুদী-বিহনে যথা কুমুদরঞ্জন
শশাঙ্ক! লক্ষ্মণ সঙ্ঘে, বায়ুপুত্র হনু,
মিত্রবর বিভীষণ। এত প্রসরণে,
বেড়িয়াছে বৈরিদল স্বর্ণ-লঙ্কাপুরী,
গহন কাননে যথা ব্যাধ-দল মিলি,
বেড়ে জালে সাবধানে কেশরিকামিনী,—
নয়ন–রমণী রূপে, পরাক্রমে ভীমা
ভীমাসমা! অদূরে হেরিলা রক্ষঃপতি
রণক্ষেত্র। শিবাকুল, গৃধিনী, শকুনি,
কুক্কুর, পিশাচদল ফেরে কোলাহলে।

ট্রেন

ট্রেন
   ---- শামসুর রাহমান

ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
          রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
         ট্রেনের বাড়ি কই ?

একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
         মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
         ঝন ঝনাঝন ঝন।

দেশ-বিদেশে বেড়ায় ঘুরে
         নেইকো ঘোরার শেষ।
ইচ্ছে হলেই বাজায় বাঁশি,
         দিন কেটে যায় বেশ।

থামবে হঠাৎ মজার গাড়ি
        একটু কেশে খক।
আমায় নিয়ে ছুটবে আবার
        ঝক ঝকাঝক ঝক।

কোনো একজনের জন্যে

কোনো একজনের জন্যে
                   ----- শামসুর রাহমান

এতকাল ছিলাম একা আর ব্যথিত,
আহত পশুর অনুভবে ছেঁড়াখোঁড়া।
দুর্গন্ধ-ভরা গুহাহিত রাত নিস্ফল ক্রোধে দীর্ণ,
শীর্ণ হাহাকার ছাড়া গান ছিল না মনে,
জানি প্রাণে ছিল না সতেজ পাতার কানাকানি
এমনকি মরম্নভূমির তীব্রতাও ছিল না ধমনীতে,
স্বপ্ন ছিল না,
ছিল না স্বপ্নের মতো হৃদয়।

কে জানতো এই খেয়ালি পতঙ্গ, শীতের ভোর,
হাওয়ায় হাওয়ায় মর্মরিত গাছ,
ঘাসে-ঢাকা জমি, ছায়া-মাখা শালিক
প্রিয় গানের কলি হয়ে গুঞ্জরিত হবে
ধমনীতে, পেখম মেলবে নানা রঙের মুহূর্তে।
কে জানতো লেখার টেবিলে রাখা বাসি রম্নটি
আর ফলের শুকনো খোসাগুলো
তাকাবে আমার দিকে অপলক
আত্মীয়ের মতো?

তুমি বলেছিলে

তুমি বলেছিলে
             ----- শামসুর রাহমান

দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।
পুড়ছে দোকান-পাট, কাঠ,
লোহা-লক্কড়ের স্তূপ, মসজিদ এবং মন্দির।
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।

বিষম পুড়ছে চতুর্দিকে ঘর-বাড়ি।
পুড়ছে টিয়ের খাঁচা, রবীন্দ্র রচনাবলি, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার,
মানচিত্র, পুরনো দলিল।
মৌচাকে আগুন দিলে যেমন সশব্দে
সাধের আশ্রয় ত্যাগী হয়
মৌমাছির ঝাঁক,
তেমনি সবাই
পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্বিদিক। নবজাতককে
বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী
বনপোড়া হরিণীর মত যাচ্ছে ছুটে।
অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গী জীপ। আর্ত
শব্দ সবখানে। আমাদের দু'জনের
মুখে খরতাপ। আলিঙ্গনে থরো থরো
তুমি বলেছিলে,
‌'আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও,
আমাকে লুকিয়ে ফেলো চোখের পাতায়
বুকের অতলে কিংবা একান্ত পাঁজরে
আমাকে নিমেষে শুষে নাও
চুম্বনে চুম্বনে।'

দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার,
আমাদের চৌদিকে আগুন,
গুলির ইস্পাতী শিলাবৃষ্টি অবিরাম।
তুমি বলেছিলে
আমাকে বাঁচাও।
অসহায় আমি তাও বলতে পারিনি।

পণ্ডশ্রম

পণ্ডশ্রম
      ----- শামসুর রাহমান

এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতারবিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।
দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,
কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে।
কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল?
কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল।
যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরেছে চিলে,
পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে।
সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি,
যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই।
মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু,
ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু!
ছুটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে
কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?
নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;
কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।
ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?
বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।

অভিশাপ দিচ্ছি

অভিশাপ দিচ্ছি
            ----- শামসুর রাহমান

আজ এখানে দাড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ঞপক্ষ
দিয়েছিলো সেঁটে,
মগজের কোষে কোষে যারা
পুতেছিলো আমাদেরই আপনজনের লাশ
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত,
যারা গনহত্যা
করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক
পশু সেই সব পশুদের।
ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের
সারিবদ্ধ দাঁড়
করিয়ে নিমিষে ঝা ঝা বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকে বুকে যাবে তা আমি মানি না।
হত্যাকে উতসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে
ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভতস গন্ধ দিয়েছে
ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না
কামনা।
আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত
সিড়ি ভেন্গে যেতে আসতে
নদীতে আর বনবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে
অভিশাপ দিচ্ছি আজ সেইখানে দজ্জালদের।

একটি ফটোগ্রাফ

একটি ফটোগ্রাফ
            ------ শামসুর রাহমান

এই যে আসুন, তারপর কী খবর?
আছেন তো ভাল? ছেলেমেয়ে?’ কিছু আলাপের পর
দেখিয়ে সফেদ দেয়ালের শান্ত ফটোগ্রাফটিকে
বললাম জিজ্ঞাসু অতিথিকে–
‘এই যে আমার ছোট ছেলে, যে নেই এখন,
পাথরের টুকরোর মতন
ডুবে গেছে আমাদের গ্রামের পুকুরে
বছর-তিনেক আগে কাক-ডাকা গ্রীষ্মের দুপুরে।’
কী সহজে হয়ে গেল বলা,
কাঁপলো না গলা
এতটুকু, বুক চিরে বেরুলো না দীর্ঘশ্বাস, চোখ ছলছল
করলো না এবং নিজের কন্ঠস্বর শুনে
নিজেই চমকে উঠি, কি নিস্পৃহ, কেমন শীতল।
তিনটি বছর মাত্র তিনটি বছর
কত উর্ণাজাল বুনে
কেটেছে, অথচ এরই মধ্যে বাজখাঁই
কেউ যেন আমার শোকের নদীটিকে কত দ্রুত রুক্ষ চর
করে দিলো। অতিথি বিদায় নিলে আবার দাঁড়াই
এসে ফটোগ্রাফটির প্রশ্নাকুল চোখে,
ক্ষীয়মান শোকে।
ফ্রেমের ভেতর থেকে আমার সন্তান
চেয়ে থাকে নিষ্পলক,তার চোখে নেই রাগ কিংবা অভিমান।

উত্তর

উত্তর
    ----- শামসুর রাহমান

তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো
‘এই আকাশ আমার’
কিন্তু নীল আকাশ কোনো উত্তর দেবেনা।

সন্ধ্যেবেলা ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে বলতেই পারো,
‘ফুল তুই আমার’
তবু ফুল থাকবে নীরব নিজের সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে।

জ্যোত্স্না লুটিয়ে পড়লে তোমার ঘরে,
তোমার বলার অধিকার আছে, ‘এ জ্যোত্স্না আমার’
কিন্তু চাঁদিনী থাকবে নিরুত্তর।

মানুষ আমি, আমার চোখে চোখ রেখে
যদি বলো, ‘তুমি একান্ত আমার’, কী করে থাকবো নির্বাক ?
তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, ‘আমি তোমার, তুমি আমার’।

স্বাধীনতা তুমি

স্বাধীনতা তুমি
        ----- শামসুর রাহমান

স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ।
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।

ম’রে যেতে সাধ হয়

ম’রে যেতে সাধ হয়
                  ------ আনিসুল হক

শাহানা, তুমি গোলাপী জামা প’রে জীবন্ত গোলাপের মতো
ক্যাম্পাসে এসো না, আমার খারাপ লাগে।

সখী পরিবৃতা হয়ে মোগল-দুহিতার মতো
করিডোরে অমন ক’রে হেঁটো না, আমার খারাপ লাগে।

শাহানা, তুমি চিবুক নাড়িয়ে
রাঙা মাড়িতে
দুধ শাদা হাতে
লালিম জিহ্বায়
গিটারের তারের মতো বেজে উঠো না —
দরদালান কেঁপে উঠে, ঢিল পড়ে বুকের পুকুরে,
কাঁপে পানি থিরিথিরি, আমার খারাপ লাগে।

শাহানা, তুমি টিফিন আওয়ারে ক্লাসরুমে ব’সে
অমন করে রাধার মতো দীর্ঘ চুল মেলে দিও না
অন্ধকার করে আসে সারাটা আকাশ
নিবে যায় সবগুলি নিয়ন
কালো মেঘের উপমা দিতে আমার ভালো লাগে না।

শাহানা, তুমি ক্যাফেটেরিয়ায় নিরেট চায়ের কাপে
ওই দুটি ঠোঁট রেখো না;
নিদাঘ খরার পোড়ে ঠোঁটের বাগান,
মরুভূর মতো জ্বলে তৃষ্ণার্ত সবুজ;

আমার মরে যেতে সাধ হয়।

ছিন্নমুকুল

ছিন্নমুকুল
      ---- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

সবচেয়ে যে ছোট পিড়ি খানি
সেখানি আর কেউ রাখেনা পেতে,
ছোটথালায় হয় নাকো ভাতবাড়া
জল ভরে না ছোট্ট গেলাসেতে।
বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট
খাবার বেলা কেউ ডাকে না তাকে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল,
তারই খাওয়া ঘুচেছে সব আগে।

সবচেয়ে যে অল্পে ছিল খুশি,
খুশি ছিল ঘেষাঘেষির ঘরে,
সেই গেছে হায়, হাওয়ার সঙ্গে মিশে,
দিয়ে গেছে জায়গা খালি করে।
ছেড়ে গেছে পুতুল, পুঁতির মালা,
ছেড়ে গেছে মায়ের কোলের দাবি।
ভয়ভরা সে ছিল যে সব চেয়ে
সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি।

হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে ওরে!
হারিয়ে গেছে 'বোল' বলা সেই বাঁশি
দুধে ধোওয়া কচি সে মুখখানি
আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জলে
ভেসে গেছে শিউলী ফুলের রাশি,
ঢুকেছে হায় শশ্মান ঘরের মাঝে
ঘর ছেড়ে হায় হৃদয় শশ্মানবাসী।

সবচেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি
সেইগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট,
আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল
সেই গিয়েছে সবার আগে সরে।
ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে,
সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।

চম্পা

চম্পা
    ----- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

আমারে ফুটিতে হ’লো বসন্তের অন্তিম নিশ্বাসে,
বিষণ্ণ যখন বিশ্ব নির্মম গ্রীষ্মের পদানত;
রুদ্র তপস্যার বনে আধ ত্রাসে আধেক উল্লাসে,
একাকী আসিতে হ’লো সাহসিকা অপ্সরার মতো।
বনানী শোষণ-ক্লিষ্ট মর্মরি’ উঠিল এক বার,
বারেক বিমর্ষ কুঞ্জে শোনা গেল ক্লান্ত কুহু স্বর;
জন্ম-যবনিকা-প্রান্তে মেলি’ নব নেত্র সুকুমার
দেখিলাম জলস্থল, - শুন্য, শুষ্ক, বিহ্বল, জর্জর।
তবু এনু বাহিরিয়া,- বিশ্বাসের বৃন্তে বেপমান, –
চম্পা আমি, -খর তাপে আমি কভু ঝরিবো না মরি,
উগ্র মদ্য-সম রৌদ্র - যার তেজে বিশ্ব মুহ্যমান, –
বিধাতার আশির্বাদে আমি তা সহজে পান করি।
ধীরে এনু বাহিরিয়া, ঊষার আতপ্ত কর ধরি’;
মূর্ছে দেহ, মোহে মন,- মুহুর্মুহু করি অনুভব!
সূর্যের বিভূতি তবু লাবণ্যে দিতেছ তনু ভরি’;
দিনদেবে নমস্কার! আমি চম্পা! সূর্যের সৌরভ

ঝর্ণা

ঝর্ণা
     ---- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

ঝর্ণা! ঝর্ণা! সুন্দরী ঝর্ণা!
তরলিত চন্দ্রিকা! চন্দন-বর্ণা!
     অঞ্চল সিঞ্চিত গৈরিকে স্বর্ণে,
     গিরি-মল্লিকা দোলে কুন্তলে কর্ণে,
তনু ভরি' যৌবন, তাপসী অপর্ণা!
            ঝর্ণা!
পাষাণের স্নেহধারা! তুষারের বিন্দু!
ডাকে তোরে চিত-লোল উতরোল সিন্ধু|
     মেঘ হানে জুঁইফুলী বৃষ্টি ও-অঙ্গে,
     চুমা-চুমকীর হারে চাঁদ ঘেরে রঙ্গে,
ধূলা-ভরা দ্যায় ধরা তোর লাগি ধর্ণা!
             ঝর্ণা!
এস তৃষার দেশে এস কলহাস্যে -
গিরি-দরী-বিহীরিনী হরিনীর লাস্যে,
     ধূসরের ঊষরের কর তুমি অন্ত,
     শ্যামলিয়া ও পরশে কর গো শ্রীমন্ত;
ভরা ঘট এস নিয়ে ভরসায় ভর্ণা;
             ঝর্ণা!
শৈলের পৈঠৈয় এস তনুগত্রী!
পাহাড়ে বুক-চেরা এস প্রেমদাত্রী!
     পান্নার অঞ্জলি দিতে দিতে আয় গো,
     হরিচরণ-চ্যুতা গঙ্গার প্রায় গো,
স্বর্গের সুধা আনো মর্ত্যে সুপর্ণা!
             ঝর্ণা!
মঞ্জুল ও-হাসির বেলোয়ারি আওয়াজে
ওলো চঞ্চলা ! তোর পথ হল ছাওয়া যে!
     মোতিয়া মোতির কুঁড়ি মূরছে ও-অলকে;
     মেখলায়, মরি মরি, রামধনু ঝলকে
তুমি স্বপ্নের সখী বিদ্যুত্পর্ণা
             ঝর্ণা!

দূরের পাল্লা

দূরের পাল্লা
        ----- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

ছিপখান তিন-দাঁড় -
তিনজন মাল্লা
চৌপর দিন-ভোর
দ্যায় দূর-পাল্লা!
         পাড়ময় ঝোপঝাড়
         জঙ্গল-জঞ্জাল,
         জলময় শৈবাল
         পান্নার টাঁকশাল |
কঞ্চির তীর-ঘর
ঐ-চর জাগছে,
বন-হাঁস ডিম তার
শ্যাওলায় ঢাকছে|
         চুপ চুপ - ওই ডুব
         দ্যায় পান্ কৌটি
         দ্যায় ডুব টুপ টুপ
         ঘোমটার বৌটি!
ঝকঝক কলসীর
বক্ বক্ শোন্ গো
ঘোমটার ফাঁক বয়
মন উন্মন গো|
         তিন-দাঁড় ছিপখান
         মন্থর যাচ্ছে,
         তিনজন মাল্লায়
         কোন গান গাচ্ছে?
রূপশালি ধান বুঝি
এইদেশে সৃষ্টি,
ধুপছায়া যার শাড়ী
তার হাসি মিষ্টি|
         মুখখানি মিষ্টিরে
         চোখদুটি ভোমরা
         ভাব-কদমের - ভরা
         রূপ দেখ তোমরা !
ময়নামতীর জুটি
ওর নামই টগরী,
ওর পায়ে ঢেউ ভেঙে
জল হোলো গোখরী!
         ডাক পাখী ওর লাগি'
         ডাক ডেকে হদ্দ,
         ওর তরে সোঁত-জলে
         ফুল ফোটে পদ্ম|
ওর তরে মন্থরে
নদ হেথা চলছে,
জলপিপি ওর মৃদু
বোল বুঝি বোলছে|
         দুইতীরে গ্রামগুলি
         ওর জয়ই গাইছে,
         গঞ্জে যে নৌকা সে
         ওর মুখই চাইছে|
আটকেছে যেই ডিঙা
চাইছে সে পর্শ,
সঙ্কটে শক্তি ও
সংসারে হর্ষ|
         পান বিনে ঠোঁট রাঙা
         চোখ কালো ভোমরা,
         রূপশালী-ধান-ভানা
         রূপ দেখ তোমরা

*        *        *        *
 
পান সুপারি! পান সুপারি!
এইখানেতে শঙ্কা ভারি,
পাঁচ পীরেরই শীর্ণি মেনে
চলরে টেনে বৈঠা হেনে;
বাঁক সমুখে, সামনে ঝুঁকে
বাঁয় বাঁচিয়ে ডাইনে রুখে
বুক দে টানো, বইটা হানো -
সাত সতেরো কোপ কোপানো|
হাড়-বেরুনো খেজুরগুলো
ডাইনী যেন ঝামর-চুলো
নাচতে ছিল সন্ধ্যাগমে
লোক দেখে কি থমকে গেল|
জমজমাটে জাঁকিয়ে ক্রমে
রাত্রি এল রাত্রি এল|
ঝাপসা আলোয় চরের ভিতে
ফিরছে কারা মাছের পাছে,
পীর বদরের কুদরতিতে
নৌকা বাঁধা হিজল-গাছে|

*        *        *        *
   
আর জোর দেড় ক্রোশ -
জোর দের ঘন্টা,
টান ভাই টান সব -
নেই উত্কণ্ঠা|
         চাপ চাপ শ্যাওলার
         দ্বীপ সব সার সার,
         বৈঠৈর ঘায়ে সেই
         দ্বীপ সব নড়ছে,
         ভিল্ ভিলে হাঁস তায়
         জল-গায় চড়ছে|
ওই মেঘ জমছে,
চল্ ভাই সমঝে,
গান গাও দাও শিশ,
বকশিশ! বকশিশ!
         খুব জোর ডুব-জল
         বয় স্রোত ঝিরঝির,
         নেই ঢেউ কল্লোল,
         নয় দুর নয় তীর|
নেই নেই শঙ্কা,
চল্ সব ফুর্তি,
বকশিশ টঙ্কা,
বকশিশ ফুর্তি|
         ঘোর-ঘোর সন্ধ্যায়,
         ঝাউ-গাছ দুলছে,
         ঢোল-কলমীর ফুল
         তন্দ্রায় ঢুলছে|
লকলক শর-বন
বক তায় মগ্ন,
চুপচাপ চারদিক -
সন্ধ্যার লগ্ন|
         চারদিক নিঃসাড়,
         ঘোর-ঘোর রাত্রি,
         ছিপ-খান তিন-দাঁড়,
         চারজন যাত্রি|

*        *        *        *
 
জড়ায় ঝাঁঝি দাঁড়ের মুখে
ঝউয়ের বীথি হাওয়ায় ঝুঁকে
ঝিমায় বুঝি ঝিঁঝিঁর গানে -
স্বপন পানে পরাণ টানে|
        তারায় ভরা আকাশ ওকি
        ভুলোয় পেয়ে ধূলোর পরে
        লুটিয়ে পল আচম্বিতে
        কুহক-মোহ-মন্ত্র-ভরে!

*        *        *        *
 
কেবল তারা! কেবল তারা!
শেষের শিরে মানিক পারা,
হিসাব নাহি সংখ্যা নাহি
কেবল তারা যেথায় চাহি|
        কোথায় এল নৌকাখানা
        তারার ঝড়ে হই রে কাণা,
        পথ ভুলে কি এই তিমিরে
        নৌকা চলে আকাশ চিরে!
জ্বলছে তারা! নিভছে তারা!
মন্দাকিনীর মন্দ সোঁতায়,
যাচ্ছে ভেসে যাচ্ছে কোথায়
জোনাক যেন পন্থা-হারা|
        তারায় আজি ঝামর হাওয়া-
        ঝামর আজি আঁধার রাতি,
        অগুনতি অফুরান তারা
        জ্বালায় যেন জোনাক-বাতি|
কালো নদীর দুই কিনারে
কল্পতরু কুঞ্জ কি রে?
ফুল ফুটেছে ভারে ভারে -
ফুল ফুটেছে মাণিক হীরে|
        বিনা হাওয়ায় ঝিলমিলিয়ে
        পাপড়ি মেলে মাণিক-মালা;
        বিনি নাড়ায় ফুল ঝরিছে
        ফুল পড়িছে জোনাক জ্বালা|
চোখে কেমন লগছে ধাঁধা -
লাগছে যেন কেমন পারা,
তারাগুলোই জোনাক হল
কিম্বা জোনাক হল তারা|
        নিথর জলে নিজের ছায়া
        দেখছে আকাশ ভরা তারায়,
        ছায়া-জোনাক আলিঙ্গিতে
        জলে জোনাক দিশে হারায়|
দিশে হারায় যায় ভেসে যায়
স্রোতের টানে কোন্ দেশে রে?
মরা গাঙ আর সুর-সরিত্
এক হয়ে যেথায় মেশে রে!
        কোথায় তারা ফুরিয়েছে, আর
        জোনাক কোথা হয় সুরু যে
        নেই কিছুরই ঠিক ঠিকানা
        চোখ যে আলা রতন উঁছে|
আলেয়াগুলো দপদপিয়ে
জ্বলছে নিবে, নিবছে জ্বলে',
উল্কোমুখী জিব মেলিয়ে
চাটছে বাতাশ আকাশ-কোলে!
        আলেয়া-হেন ডাক-পেয়াদা
        আলেয়া হতে ধায় জেয়াদা
        একলা ছোটে বন বাদাড়ে
        ল্যাম্পো-হাতে লকড়ি ঘাড়ে;
সাপ মানে না, ভাঘ জানে না,
ভূতগুলো তার সবাই চেনা,
ছুটছে চিঠি পত্র নিয়ে
রণরণিয়ে হনহনিয়ে|
        বাঁশের ঝোপে জাগছে সাড়া,
        কোল্-কুঁজো বাঁশ হচ্ছে খাড়া,
        জাগছে হাওয়া জলের ধারে,
        চাঁদ ওঠেনি আজ আঁধারে!
শুকতারাটি আজ নিশীথে
দিচ্ছে আলো পিচকিরিতে,
রাস্তা এঁকে সেই আলোতে
ছিপ চলেছে নিঝুম স্রোতে|
        ফিরছে হাওয়া গায় ফুঁ-দেওয়া,
        মাল্লা মাঝি পড়ছে থকে;
        রাঙা আলোর লোভ দেখিয়ে
        ধরছে কারা মাছগুলোকে!
চলছে তরী চলছে তরী -
আর কত পথ? আর ক'ঘড়ি?
এই যে ভিড়াই, ওই যে বাড়ী,
ওই যে অন্ধকারের কাঁড়ি -
        ওই বাঁধা-বট ওর পিছন্
        দেখছ আলো? ঐতো কুঠি
        ঐখানেতে পৌঁছে দিলেই
        রাতের মতন আজকে ছুটি|
ঝপ ঝপ তিনখান
দাঁড় জোর চলছে,
তিনজন মাল্লার
হাত সব জ্বলছে;
        গুরগুর মেঘ সব
        গায় মেঘ মল্লার,
        দূর-পাল্লার শেষ
        হাল্লাক্ মাল্লার!

অপরাজিতা

অপরাজিতা
        ----- যতীন্দ্রমোহন বাগচী

পরাজিতা তুই সকল ফুলের কাছে,
তবু কেন তোর অপরাজিতা নাম?
বর্ণ-সেও ত নয় নয়নাভিরাম |
ক্ষুদ্র অতসী, তারো কাঞ্চন-ভাতি ;
রূপগুণহীন বিড়ম্বনার খ্যাতি!
কালো আঁখিপুটে শিশির-অশ্রু ঝরে—
ফুল কহে—মোর কিছু নাই কিছু নাই,
ফুলসজ্জায় লজ্জায় যাই নাক,
বিবাহ-বাসরে থাকি আমি ম্রিয়মাণ |
মোর ঠাঁই শুধু দেবের চরণতলে,
পূজা-শুধু-পূজা জীবনের মোর ব্রত ;
তিনিও কি মোরে ফিরাবেন আঁখিজলে—

অন্ধ বধূ

অন্ধ বধূ
           ----- যতীন্দ্রমোহন বাগচী

পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী!
আস্তে একটু চলনা ঠাকুর-ঝি —
ওমা, এ যে ঝরা-বকুল ! নয়?
তাইত বলি, বদোরের পাশে,
রাত্তিরে কাল — মধুমদির বাসে
আকাশ-পাতাল — কতই মনে হয় ।
জ্যৈষ্ঠ আসতে কদিন দেরি ভাই —
আমের গায়ে বরণ দেখা যায় ?
—অনেক দেরি? কেমন করে’ হবে !
কোকিল-ডাকা শুনেছি সেই কবে,
দখিন হাওয়া —বন্ধ কবে ভাই ;
দীঘির ঘাটে নতুন সিঁড়ি জাগে —
শেওলা-পিছল — এমনি শঙ্কা লাগে,
পা-পিছলিয়ে তলিয়ে যদি যাই!
মন্দ নেহাৎ হয়না কিন্তু তায় —
অন্ধ চোখের দ্বন্ধ চুকে’ যায়!
দুঃখ নাইক সত্যি কথা শোন্ ,
অন্ধ গেলে কী আর হবে বোন?
বাঁচবি তোরা —দাদা তো তার আগে?
এই আষাড়েই আবার বিয়ে হবে,
বাড়ি আসার পথ খুঁজে’ না পাবে —
দেখবি তখন —প্রবাস কেমন লাগে ?
—কী বল্লি ভাই, কাঁদবে সন্ধ্যা-সকাল ?
হা অদৃষ্ট, হায়রে আমার কপাল !
কত লোকেই যায় তো পরবাসে —
কাল-বোশেখে কে না বাড়ি আসে ?
চৈতালি কাজ, কবে যে সেই শেষ !
পাড়ার মানুষ ফিরল সবাই ঘর,
তোমার ভায়ের সবই স্বতন্তর —
ফিরে’ আসার নাই কোন উদ্দেশ !
—ঐ যে হথায় ঘরের কাঁটা আছে —
ফিরে’ আসতে হবে তো তার কাছে !
এই খানেতে একটু ধরিস ভাই,
পিছল-ভারি — ফসকে যদি যাই —
এ অক্ষমার রক্ষা কী আর আছে !
আসুন ফিরে’ — অনেক দিনের আশা,
থাকুন ঘরে, না থাক্ ভালবাসা —
তবু দুদিন অভাগিনীর কাছে!
জন্ম শোধের বিদায় নিয়ে ফিরে’ —
সেদিন তখন আসব দীঘির তীরে।
‘চোখ গেল ঐই চেঁচিয়ে হ’ল সারা।
আচ্ছা দিদি, কি করবে ভাই তারা —
জন্ম লাগি গিয়েছে যার চোখ !
কাঁদার সুখ যে বারণ তাহার — ছাই!
কাঁদতে গেলে বাঁচত সে যে ভাই,
কতক তবু কমত যে তার শোক!
‌‌‍‍‍‌’চোখ’ গেল– তার ভরসা তবু আছে —
চক্ষুহীনার কী কথা কার কাছে !
টানিস কেন? কিসের তাড়াতাড়ি —
সেই তো ফিরে’ যাব আবার বাড়ি,
একলা-থাকা-সেই তো গৃহকোণ —
তার চেয়ে এই স্নিগ্ধ শীতল জলে
দুটো যেন প্রাণের কথা বলে —
দরদ-ভরা দুখের আলাপন
পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মতো
ভুলায় খানিক মনের ব্যথা যত !
এবার এলে, হাতটি দিয়ে গায়ে
অন্ধ আঁখি বুলিয়ে বারেক পায়ে —
বন্ধ চোখের অশ্রু রুধি পাতায়,
জন্ম-দুখীর দীর্ঘ আয়ু দিয়ে
চির-বিদায় ভিক্ষা যাব নিয়ে —
সকল বালাই বহি আপন মাথায় ! —
দেখিস তখন, কানার জন্য আর
কষ্ট কিছু হয় না যেন তাঁর।
তারপরে – এই শেওলা-দীঘির ধার —
সঙ্গে আসতে বলবনা’ক আর,
শেষের পথে কিসের বল’ ভয় —
এইখানে এই বেতের বনের ধারে,
ডাহুক-ডাকা সন্ধ্যা-অন্ধকারে —
সবার সঙ্গে সাঙ্গ পরিচয়।
শেওলা দীঘির শীতল অতল নীরে —
মায়ের কোলটি পাই যেন ভাই ফিরে’!

যৌবন-চাঞ্চল্য

যৌবন-চাঞ্চল্য
                   ----- যতীন্দ্রমোহন বাগচী

ভুটিয়া যুবতি চলে পথ;
আকাশ কালিমামাখা কুয়াশায় দিক ঢাকা।
চারিধারে কেবলই পর্বত;
যুবতী একেলা চলে পথ।
এদিক-ওদিক চায় গুনগুনি গান গায়,
কভু বা চমকি চায় ফিরে;
গতিতে ঝরে আনন্দ উথলে নৃত্যের ছন্দ
আঁকাবাঁকা গিরিপথ ঘিরে।
ভুটিয়া যুবতি চলে পথ।

টসটসে রসে ভরপুর--
আপেলের মত মুখ আপেলের মত বুক
পরিপূর্ণ প্রবল প্রচুর;
যৌবনের রসে ভরপুর।
মেঘ ডাকে কড়-কড় বুঝিবা আসিবে ঝড়,
একটু নাহিকো ডর তাতে;
উঘারি বুকের বাস, পুরায় বিচিত্র আশ
উরস পরশি নিজ হাতে!

অজানা ব্যাথায় সুমধুর--
সেথা বুঝি করে গুরুগুরু!
যুবতি একেলা পথ চলে;
পাশের পলাশ-বনে কেন চায় অকারণে?
আবেশে চরণ দুটি টলে--
পায়ে-পায়ে বাধিয়া উপলে!
আপনার মনে যায় আপনার মনে গায়,
তবু কেন আনপানে টান?
করিতে রসের সৃষ্টি চাই কি দশের দৃষ্টি?
--স্বরূপ জানেন ভগবান!

সহজে নাচিয়া যেবা চলে
একাকিনী ঘন বনতলে--
জানি নাকো তারো কী ব্যাথায়
আঁখিজলে কাজল ভিজায়!

আমাদের গ্রাম

আমাদের গ্রাম
                     -----বন্দে আলী মিঞা

আমাদের ছোটো গাঁয়ে ছোটো ছোটো ঘর
থাকি সেথা সবে মিলে কেহ নাহি পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই
একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।
হিংসা ও মারামারি কভু নাহি করি,
পিতা-মাতা গুরুজনে সদা মোরা ডরি।
আমাদের ছোটো গ্রামে মায়ের সমান,
আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।
মাঠভরা ধান আর জলভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আমগাছ জামগাছ বাঁশ ঝাড় যেন,
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।
সকালে সোনার রবি পূব দিকে ওঠে
পাখি ডাকে, বায়ু বয়, নানা ফুল ফোটে।

দেহতত্ত্ব

দেহতত্ত্ব
     – তসলিমা নাসরিন

এতকাল চেনা এই আমার শরীর
সময় সময় একে আমি নিজেই চিনি না।
একটি কর্কশ হাত
নানান কৌশল করে চন্দন চর্চ্চিত হাতখানি ছুঁলে
আমার স্নায়ুর ঘরে ঘণ্টি বাজে, ঘণ্টি বাজে
এ আমার নিজের শরীর
শরীরের ভাষা আমি পড়তে পারি না।
সে নিজেই তার কথা বলে নিজের ভাষায়।
তখন আঙুল, চোখ, ঠোঁট, এই মসৃণ পা
কেউই আমার নয়।
এ আমারই নয়
এ আমারই হাত।
অথচ এ হাত আমি সঠিক চিনি না
এই আমারই ঠোঁট, এ আমার জংঘা-উরু
এসবের কোন পেশী, কোন রোমকূপ
আমার অধীন নয়, নিয়ন্ত্রিত নয়।
স্নায়ুর দোতলা ঘরে ঘণ্টি বাজে
এই পৃথিবীতে আমি তবে কার ক্রীড়নক
পুরুষ না প্রকৃতির ?
আসলে পুরুষ নয়
প্রকৃতিই আমাকে বাজায়
আমি তার শখের সেতার।
পুরুষের স্পর্শে আমি
ঘুমন্ত শৈশব ভেঙে জেগে উঠি
আমার সমুদ্রে শুরু হয় হঠাৎ জোয়ার।
রক্তে মাংসে ভালবাসার সুগন্ধ পেলে
প্রকৃতিই আমাকে বাজায়
আমি তার শখের সেতার।

বাঁচো

বাঁচো
    – তসলিমা নাসরিন

সত্য বললে কিছু লোক আছে খুব রাগ করে,
এখন থেকে আর সত্য বোলো না তসলিমা।
গ্যালিলিওর যুগ নয় এই যুগ, কিন্তু
এই একবিংশ শতাব্দীতেও
সত্য বললে একঘরে করে রাখে সমাজ,
দেশছাড়া করে দেশ।
গৃহবন্দী করে রাষ্ট্র,
রাষ্ট্র শাস্তি দেয়,
সত্য বোলো না।
তার চেয়ে মিথ্যে বলো,
বলো যে পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে,
বলো যে সূর্যের যেমন নিজের আলো আছে, চাঁদেরও আছে,
বলো যে পাহাড়গুলো পৃথিবীর গায়ে পেরেকের মতো পুঁতে দেওয়া,
বলো যে পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকেনারীকে বানানো,
বলো যে নারীর ঘাড়ের কী যেন একটা খুব বাকা।
বলো যে শেষ-বিচারের দিনে মানুষেরা সব কবর থেকে,
ছাই থেকে, নষ্ট হাড়গোড় থেকে টাটকা যুবক যুবতী হয়ে
আচমকা জেগে উঠবে, স্বর্গ বা নরকে অনন্তকালের জন্য জীবন কাটাতে যাবে।
তুমি মিথ্যে বলো তসলিমা।
বলো যে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অগুণতি গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্ররাজি মিথ্যে,
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মিথ্যে, মানুষ চাঁদে গিয়েছিল, মিথ্যে।
মিথ্যে বললে তুমি নির্বাসন থেকে মুক্তি পাবে,
তুমি দেশ পাবে, প্রচুর বন্ধু পাবে,
হাত পায়ের শেকল খুলে দেওয়া হবে, তুমি আলো দেখবে, আকাশ দেখবে।
একা একা অন্ধকারে হাঁমুখো মৃত্যুর মুখে ছুড়ে দেবে না তোমাকে কেউ।
তুমি সত্য বলো না তসলিমা,
বাঁচো।

হাত

হাত
   – তসলিমা নাসরিন

আবার আমি তোমার হাতে রাখবো বলে হাত
গুছিয়ে নিয়ে জীবনখানি উজান ডিঙি বেয়ে
এসেছি সেই উঠোনটিতে গভীর করে রাত
দেখছ না কি চাঁদের নীচে দাঁড়িয়ে কাঁদি দুঃখবতী মেয়ে !
আঙুলগুলো কাঁপছে দেখ, হাত বাড়াবেকখন ?
কুয়াশা ভিজে শরীরখানা পাথর হয়ে গেলে ?
হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম বর্ষা ছিল তখন,
তখন তুমি ছিঁড়ে খেতে আস্ত কোনও নারী নাগাল পেলে।
শীতের ভারে ন্যুব্জ বাহু স্পর্শ করে দেখি
ভালবাসার মন মরেছে, শরীর জবুথবু,
যেদিকে যাই, সেদিকে এত ভীষণ লাগে মেকি।
এখনও তুমি তেমন আছ। বয়স গেল, বছর গেল, তবু।
নিজের কাঁধে নিজের হাত নিজেই রেখে বলি :
এসেছিলাম পাশের বাড়ি, এবার তবে চলি।

সময়

সময় 
   – তসলিমা নাসরিন

রাত তিনটেয় ঘুম ভেঙে গেলে এখন আর বিরক্ত হই না
রাতে ভালো ঘুম না হলে দিনটা ভাল কাটে না – এমান বলে লোকে ।
দিন যদি ভাল না কাটে তাহলে কি কিছু যায় আসে !
আমার দিনই বা কেন , রাতই বা কেন ?
দিন দিনের মতো বসে থাকে দূরে , আর রাত রাতের মতো ,
ঘুমিয়ে থাকার গায়ে মুখ গুঁজে গুঁটি গুঁটি শুয়ে থাকে জেগে থাকা ।

এসব দিন রাত , এসব সময় , এসব বিয়ে আমার করার কিছুই নেই ,
জীবন আর মৃত্যু একাকার হয়ে গেলে কিছু আর করার থাকে না কিছু না ।
আমি এখন মৃত্যু থেকে জীবনকে বলে কয়েও সরাতে পারি না ,
জীবন থেকে মৃত্যুকে আলগোছে তুলে নিয়ে রাখতে পারি না কোথাও আপাতত ।

চরিত্র

চরিত্র
   – তসলিমা নাসরিন

তুমি মেয়ে,
তুমি খুব ভাল করে মনে রেখো
তুমি যখন ঘরের চৌকাঠ ডিঙোবে
লোকে তোমাকে আড়চোখে দেখবে।
তুমি যখন গলি ধরে হাঁটতে থাকবে
লোকে তোমার পিছু নেবে, শিস দেবে।
তুমি যখন গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠবে
লোকে তোমাকে চরিত্রহীন বলে গাল দেবে।
যদি তুমি অপদার্থ হও
তুমি পিছু ফিরবে
আর তা না হলে
যেভাবে যাচ্ছ, যাবে।

আদর্শ ছেলে

আদর্শ ছেলে
     ----কুসুমকুমারী দাশ

আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন
‘মানুষ হইতে হবে’- এই তার পণ।
বিপদ আসিলে কাছে হও আগুয়ান
নাই কি শরীরে তব রক্ত, মাংস, প্রাণ?
হাত পা সবারই আছে, মিছে কেন ভয়?
চেতনা রয়েছে যার, সে কি পড়ে রয়?
সে ছেলে কে চাই বল, কথায় কথায়
আসে যার চোখে জল, মাথা ঘুরে যায়?মনে প্রাণে খাট সবে, শক্তি কর দান,
তোমরা ‘মানুষ’ হলে দেশের কল্যাণ।

জাগবার দিন আজ

জাগবার দিন আজ

            ----সুকান্ত ভট্টাচার্যের

জাগবার দিন আজ, দুর্দিন চুপিচুপি আসছে ;
যাদের চোখেতে আজো স্বপ্নের
ছায়া ছবি ভাসছে-
তাদেরই যে দুর্দিন
পরিণামে আরো বেশী জানবে,
মৃত্যুর সঙ্গীন তাদেরই বুকেতে শেল
হানবে ।
আজকের দিন নয় কাব্যের-
আজকের সব কথা পরিণাম আর সম্ভাব্যের ;
শরতের অবকাশে শোনা যায় আকাশের
বাঁশরী,
কিন্তু বাঁশরী বৃথা, জমবে না আজ কোন
আসর-ই ।
আকাশের প্রান্তে যে মৃত্যুর
কালো পাখা বিস্তার-
মৃত্যু ঘরের কোণে, আজ আর নেই
জেনো নিস্তার,
মৃত্যুর কথা আজ ভাবতেও পাও বুঝি কষ্ট
আজকের এই কথা জানি লাগবেই অস্পষ্ট ।
তবুও তোমার চাই চেতনা,
চেতনা থাকলে আজ দুর্দিন আশ্রয় পেত না,
আজকে রঙিন খেলা নিষ্ঠুর
হাতে করো বর্জন,
আজকে যে প্রয়োজন প্রকৃত দেশপ্রেম
অর্জন ;
তাই এসো চেয়ে দেখি পৃথ্বী
কোনখানে ভাঙে আর
কোনখানে গড়ে তার ভিত্তি ।
কোনখানে লাঞ্ছিত মানুষের প্রিয়
ব্যক্তিত্ব,
কোনখানে দানবের ‘মরণ-যজ্ঞ’
চলে নিত্য ;
পণ করো, দৈত্যের অঙ্গে
হানবো বজ্রাঘাত, মিলবো সবাই এক
সঙ্গে ;
সংগ্রাম শুরু করো মুক্তির,
দিন নেই তর্ক ও যুক্তির ।
আজকে শপথ করো সকলে
বাঁচাব আমার দেশ, যাবে না শত্রুর দখলে ;
তাই আজ ফেলে দিয়ে তুলি আর লেখনী,
একতাবদ্ধ হও এখনি ॥

নিরুদ্দেশ যাত্রা

নিরুদ্দেশ যাত্রা
           ---রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
        হে সুন্দরী ?
বলো   কোন্‌ পার ভিড়িবে তোমার
        সোনার তরী ।
যখনি শুধাই , ওগো বিদেশিনী ,
তুমি হাস শুধু , মধুরহাসিনী —
বুঝিতে না পারি , কী জানি কী আছে
        তোমার মনে ।
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি
অকূল সিন্ধু উঠিছে আকুলি ,
দূরে পশ্চিমে ডুবিছে তপন
        গগনকোণে ।
কী আছে হোথায় — চলেছি কিসের
        অন্বেষণে ?


বলো দেখি মোরে , শুধাই তোমায়
         অপরিচিতা —
ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে
         দিনের চিতা ,
ঝলিতেছে জল তরল অনল ,
গলিয়া পড়িছে অম্বরতল ,
দিক্‌বধূ যেন ছলছল-আঁখি
         অশ্রুজলে ,
হোথায় কি আছে আলয় তোমার
ঊর্মিমুখর সাগরের পার ,
মেঘচুম্বিত অস্তগিরির
         চরণতলে ?
তুমি হাস শুধু মুখপানে চেয়ে
         কথা না ব ' লে ।
হুহু ক' রে বায়ু ফেলিছে সতত
         দীর্ঘশ্বাস ।
অন্ধ আবেগে করে গর্জন
         জলোচ্ছ্বাস ।
সংশয়ময় ঘননীল নীর ,
কোনো দিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর ,
অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া
         দুলিছে যেন ।
তারি ‘ পরে ভাসে তরণী হিরণ ,
তারি ‘ পরে পড়ে সন্ধ্যাকিরণ ,
তারি মাঝে বসি এ নীরব হাসি
         হাসিছ কেন ?
আমি তো বুঝি না কী লাগি তোমার
         বিলাস হেন ।


যখন প্রথম ডেকেছিলে তুমি
         ‘ কে যাবে সাথে '
চাহিনু বারেক তোমার নয়নে
          নবীন প্রাতে ।
দেখালে সমুখে প্রসারিয়া কর
পশ্চিমপানে অসীম সাগর ,
চঞ্চল আলো আশার মতন
          কাঁপিছে জলে ।
তরীতে উঠিয়া শুধানু তখন
আছে কি হোথায় নবীন জীবন ,
আশার স্বপন ফলে কি হোথায়
          সোনার ফলে ?
মুখপানে চেয়ে হাসিলে কেবল
          কথা না ব ' লে ।
তার পরে কভু উঠিয়াছে মেঘ
          কখনো রবি —
কখনো ক্ষুব্ধ সাগর , কখনো
          শান্তছবি ।
বেলা বহে যায় , পালে লাগে বায় —
সোনার তরণী কোথা চলে যায় ,
পশ্চিমে হেরি নামিছে তপন
          অস্তাচলে ।
এখন বারেক শুধাই তোমায় ,
স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হোথায় ,
আছে কি শান্তি , আছে কি সুপ্তি
          তিমিরতলে ?
হাসিতেছ তুমি তুলিয়া নয়ন
          কথা না ব ' লে ।


আঁধার রজনী আসিবে এখনি
          মেলিয়া পাখা ,
সন্ধ্যা-আকাশে স্বর্ণ-আলোক
          পড়িবে ঢাকা ।
শুধু ভাসে তব দেহসৌরভ ,
শুধু কানে আসে জল-কলরব ,
গায়ে উড়ে পড়ে বায়ুভরে তব
          কেশের রাশি ।
বিকল হৃদয় বিবশ শরীর
ডাকিয়া তোমারে কহিব অধীর ,
‘ কোথা আছ   ওগো   করহ পরশ
          নিকটে আসি । '
কহিবে না কথা , দেখিতে পাব না
          নীরব হাসি ।

যেতে নাহি দিব

যেতে নাহি দিব
        ----রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি ; বেলা দ্বিপ্রহর ; 
            হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর । 
            জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায় 
            মধ্যাহ্ন-বাতাসে ; স্নিগ্ধ অশত্থের ছায় 
            ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিণী জীর্ণ বস্ত্র পাতি 
             ঘুমায়ে পড়েছে ; যেন রৌদ্রময়ী রাতি 
            ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম — 
            শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম । 
            গিয়েছে আশ্বিন — পূজার ছুটির শেষে 
            ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে 
            সেই কর্মস্থানে । ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে 
            বাঁধিছে জিনিসপত্র দড়াদড়ি লয়ে , 
            হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ-ঘরে ও-ঘরে । 
            ঘরের গৃহিণী , চক্ষু ছলছল করে , 
            ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার , 
            তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার 
            একদণ্ড তরে ; বিদায়ের আয়োজনে 
            ব্যস্ত হয়ে ফিরে ; যথেষ্ট না হয় মনে 
            যত বাড়ে বোঝা । আমি বলি , ‘ এ কী কাণ্ড! 
            এত ঘট এত পট হাঁড়ি সরা ভাণ্ড 
            বোতল বিছানা বাক্স   রাজ্যের বোঝাই 
            কী করিব লয়ে   কিছু এর রেখে যাই 
            কিছু লই সাথে । ' 
    
    
                            সে কথায় কর্ণপাত 
            নাহি করে কোনো জন । ' কী জানি দৈবাৎ 
            এটা ওটা আবশ্যক যদি হয় শেষে 
            তখন কোথায় পাবে বিভুঁই বিদেশে ? 
            সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান ; 

            ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান 
            গুড়ের পাটালি ; কিছু ঝুনা নারিকেল ; 
              দুই ভাণ্ড ভালো রাই-সরিষার তেল ; 
             আমসত্ত্ব আমচুর ; সের দুই দুধ — 
             এই-সব শিশি কৌটা ওষুধবিষুধ । 
             মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে , 
             মাথা খাও , ভুলিয়ো না , খেয়ো মনে করে । ' 
             বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয় । 
              বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায় । 
             তাকানু ঘড়ির পানে , তার পরে ফিরে 
             চাহিনু প্রিয়ার মুখে ; কহিলাম ধীরে , 
            ‘ তবে আসি ' । অমনি ফিরায়ে মুখখানি 
              নতশিরে চক্ষু- ' পরে বস্ত্রাঞ্চল টানি 
              অমঙ্গল অশ্রুজল করিল গোপন । 
    
    
               বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন 
              কন্যা মোর চারি বছরের । এতক্ষণ 
              অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন , 
              দুটি অন্ন মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা 
              মুদিয়া আসিত ঘুমে ; আজি তার মাতা   
              দেখে নাই তারে ; এত বেলা হয়ে যায় 
              নাই স্নানাহার । এতক্ষণ ছায়াপ্রায় 
              ফিরিতেছিল সে মোর কাছে কাছে ঘেঁষে , 
              চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে 
              বিদায়ের আয়োজন । শ্রান্তদেহে এবে 
              বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কী জানি কী ভেবে 
              চুপিচাপি বসে ছিল । কহিনু যখন 
             ‘ মা গো , আসি ' সে কহিল বিষণ্ন-নয়ন 
              ম্লান মুখে , ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় । ' 
              যেখানে আছিল বসে রহিল সেথায় , 
              ধরিল না বাহু মোর , রুধিল না দ্বার , 

           শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহ-অধিকার 
              প্রচারিল — ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' । 
              তবুও সময় হল শেষ , তবু হায় 
              যেতে দিতে হল । 
    
    
                                  ওরে মোর মূঢ় মেয়ে , 
              কে রে তুই , কোথা হতে কী শকতি পেয়ে 
              কহিলি এমন কথা , এত স্পর্ধাভরে — 
             ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' ? চরাচরে 
              কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোটো হাতে 
              গরবিনী , সংগ্রাম করিবি কার সাথে 
              বসি গৃহদ্বারপ্রান্তে শ্রান্ত ক্ষুদ্র দেহ 
              শুধু লয়ে ওইটুকু বুকভরা স্নেহ । 
              ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে 
              মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যক্ত করা সাজে 
              এ জগতে , শুধু বলে রাখা ' যেতে দিতে 
              ইচ্ছা নাহি ' । হেন কথা কে পারে বলিতে 
             ‘ যেতে নাহি দিব ' ! শুনি তোর শিশুমুখে 
              স্নেহের প্রবল গর্ববাণী , সকৌতুকে 
              হাসিয়া সংসার টেনে নিয়ে গেল মোরে , 
              তুই শুধু পরাভূত চোখে জল ভরে 
              দুয়ারে রহিলি বসে ছবির মতন , 
              আমি দেখে চলে এনু মুছিয়া নয়ন । 
    
    
               চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে 
               শরতের শস্যক্ষেত্র নত শস্যভারে 
               রৌদ্র পোহাইছে । তরুশ্রেণী উদাসীন 
                রাজপথপাশে , চেয়ে আছে সারাদিন 
               আপন ছায়ার পানে । বহে খরবেগ 
               শরতের ভরা গঙ্গা । শুভ্র খণ্ডমেঘ 

মাতৃদুগ্ধ পরিতৃপ্ত সুখনিদ্রারত 
               সদ্যোজাত সুকুমার গোবৎসের মতো 
               নীলাম্বরে শুয়ে । দীপ্ত রৌদ্রে অনাবৃত 
               যুগ-যুগান্তরক্লান্ত দিগন্তবিস্তৃত 
               ধরণীর পানে চেয়ে ফেলিনু নিশ্বাস । 
    
    
                কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ , 
                সমস্ত পৃথিবী । চলিতেছি যতদূর 
                শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর 
               ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' । ধরণীর 
                প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর 
                ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে , 
               ‘ যেতে নাহি দিব । যেতে নাহি দিব । ' সবে 
                 কহে ‘ যেতে নাহি দিব ' । তৃণ ক্ষুদ্র অতি 
                 তারেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী 
                 কহিছেন প্রাণপণে ‘ যেতে নাহি দিব ' । 
                 আয়ুক্ষীণ দীপমুখে শিখা নিব-নিব , 
                 আঁধারের গ্রাস হতে কে টানিছে তারে 
                 কহিতেছে শত বার ' যেতে দিব না রে ' । 
        এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে 
                  সব চেয়ে পুরাতন কথা , সব চেয়ে 
                  গভীর ক্রন্দন — ‘ যেতে নাহি দিব ' ।    হায় , 
                  তবু যেতে দিতে হয় , তবু চলে যায় । 
                  চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে । 
                  প্রলয়সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে 
                  প্রসারিত-ব্যগ্র-বাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে 
                 ‘ দিব না দিব না যেতে ' ডাকিতে ডাকিতে 
                  হু হু করে তীব্রবেগে চলে যায় সবে 
                  পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে । 
                  সম্মুখ-ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ 

                 ‘ দিব না দিব না যেতে ' — নাহি শুনে কেউ 
                   নাহি কোনো সাড়া । 
    
                                     চারি দিক হতে আজি 
                   অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি 
                   সেই বিশ্ব-মর্মভেদী করুণ ক্রন্দন 
                   মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে ; শিশুর মতন 
                   বিশ্বের অবোধ বাণী । চিরকাল ধরে 
                   যাহা পায় তাই সে হারায় , তবু তো রে 
                   শিথিল হল না মুষ্টি , তবু অবিরত 
                   সেই চারি বৎসরের কন্যাটির মতো 
                   অক্ষুণ্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে ডাকি 
                  ‘ যেতে নাহি দিব ' । ম্লান মুখ , অশ্রু-আঁখি , 
                   দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে টুটিছে গরব , 
                   তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব , 
                   তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধ কণ্ঠে কয় 
                  ‘ যেতে নাহি দিব ' । যত বার পরাজয় 
                       তত বার কহে , ‘ আমি ভালোবাসি যারে 
                    সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে । 
                   আমার আকাঙ্ক্ষা-সম এমন আকুল , 
                   এমন সকল-বাড়া , এমন অকূল , 
                   এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর! ' 
                   এত বলি দর্পভরে করে সে প্রচার 
                  ‘ যেতে নাহি দিব ' । তখনি দেখিতে পায় , 
                   শুষ্ক তুচ্ছ ধূলি-সম উড়ে চলে যায় 
                   একটি নিশ্বাসে তার আদরের ধন ; 
                   অশ্রুজলে ভেসে যায় দুইটি নয়ন , 
                   ছিন্নমূল তরু-সম পড়ে পৃথ্বীতলে 
                   হতগর্ব নতশির । তবু প্রেম বলে , 
                   ‘ সত্যভঙ্গ হবে না বিধির । আমি তাঁর 
                   পেয়েছি স্বাক্ষর-দেওয়া মহা অঙ্গীকার 
                   চির-অধিকার-লিপি । ' — তাই স্ফীত বুকে 

                      সর্বশক্তি মরণের মুখের সম্মুখে 
                   দাঁড়াইয়া সুকুমার ক্ষীণ তনুলতা 
                   বলে , ‘ মৃত্যু তুমি নাই । — হেন গর্বকথা! 
                   মৃত্যু হাসে বসি । মরণপীড়িত সেই 
                   চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই 
                   অনন্ত সংসার , বিষণ্ন নয়ন- ' পরে 
                   অশ্রুবাষ্প-সম , ব্যাকুল আশঙ্কাভরে 
                   চির-কম্পমান । আশাহীন শ্রান্ত আশা 
                   টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ-কুয়াশা 
                   বিশ্বময় । আজি যেন পড়িছে নয়নে — 
                   দুখানি অবোধ বাহু বিফল বাঁধনে 
                   জড়ায়ে পড়িয়া আছে নিখিলেরে ঘিরে , 
                   স্তব্ধ সকাতর । চঞ্চল স্রোতের নীরে 
                   পড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া — 
                   অশ্রুবৃষ্টিভরা কোন্‌ মেঘের সে মায়া । 
                   তাই আজি শুনিতেছি তরুরক মর্মরে 
                   এত ব্যাকুলতা ; অলস ঔদাস্যভরে 
                   মধ্যাহ্নের তপ্ত বায়ু মিছে খেলা করে 
                   শুষ্ক পত্র লয়ে ; বেলা ধীরে যায় চলে 
                   ছায়া দীর্ঘতর করি অশত্থের তলে । 
                   মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি 
                   বিশ্বের প্রান্তর-মাঝে ; শুনিয়া উদাসী 
                   বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে 
                   দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে 
                   একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য-অঞ্চল 
                   বক্ষে টানি দিয়া ; স্থির নয়নযুগল 
                   দূর নীলাম্বরে মগ্ন ; মুখে নাহি বাণী । 
                   দেখিলাম তাঁর সেই ম্লান মুখখানি 
                   সেই দ্বারপ্রান্তে লীন , স্তব্ধ মর্মাহত 
                   মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো ।